ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২ মিনিট আগে
শিরোনাম

‘পেটের ভাত জোটে না, খবর রাখে না কেউ’

  সুলতান মাহমুদ, দিনাজপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২০, ২০:২১  
আপডেট :
 ০৬ নভেম্বর ২০২০, ১৯:২৪

‘পেটের ভাত জোটে না, খবর রাখে না কেউ’

‘হামার খবর কেউ রাখে না, ওপরওয়ালা হামাক কোন পাপের শাস্তি যে দিচ্ছে। জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা আসি গেইছে, এতো কষ্ট আর সয্য করাবা (করতে) পারি না। একে তো নিজে অসুস্থ, কিছুদিন ধরি বোনের একটা হাত ভাঙি গেইছে। সেও অসুস্থ হয়া চোখের সামনে কোকাছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাবা পারছি না। হামার থাকার ঘরটা ভাঙি গেইসে। পেটের ভাতই জোটে না, ঘর ঠিক করমো কেঙ্কা (কিভাবে) করি?’

‘বাবু মেম্বার দয়া করি মোর বড় ভাই দুলাল রায়ের নামে একটা ভাতা কার্ড করি দিছে। তাছাড়া আর কোনো সুযোগ সুবিধা হামরা পাই না। বাড়িত ৩ জন প্রতিবন্ধী, অথচ কোনোরকম সুবিধা হামরা পাই না। প্রধানমন্ত্রী বলে, হামার মতো গরিব মানুষকে বাড়ি বানে (বানিয়ে) দেছে, হামাক যদি একটা ঘর দিতো, তাহলে হামরা শান্তিতে ঘুমানো হয়।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা বছিলেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার পূর্ব কাটাবাড়ী গ্রামের কানাই রায়।

আর্থিক দৈন্যতা আর সামাজিক অবমূল্যায়নে চরম কষ্টে জীবন যাপন করছেন তারা। একসময় তাদের ৩০ থেকে ৪০ বিঘা আবাদি জমি ছিলো। গোলাভর্তি ধান আর পুকুর ভরা মাছ ছিলো, ছিলো সুখের জীবন। তাদের জমি দেখাশুনার জন্য ২ থেকে ৩ জন কাজের মানুষ ছিলো। অথচ বর্তমানে তাদের একটু শান্তিতে মাথা গোঁজার ঠাই নেই। যেটুকু আছে সেটা না থাকার মতোই।

৮ শতাংশ জমির ওপর টিনশেড ছাপড়ার দুটো ভাঙা ঘর। এর মধ্যে একটি পুরোপুরি ভেঙে গেছে। বর্তমানে একটিমাত্র ঘর রয়েছে। সেখানেই কোনরকমে বসবাস করেন তারা। সেটিও যেকোনো সময় ঝড়-বাতাসে ভেঙে পড়তে পারে। সেখানে একপাশে গরু থাকে, অন্যপশে একইসাথে থাকেন ৪ ভাই ও এক বোন।

আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, তবু বিয়ে করতে পারেনি তাদের এক বোন ও চার ভাই। এমনি এক অসহায় পরিবারের খোঁজ মিলেছে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার পৌর এলাকার পূর্ব কাঁটাবাড়ী গ্রামে।

জানা গেছে, উপজেলার বড়বন্দর এলাকার ব্রিটিশ শাসনামলের পোস্টমাস্টার মৃত মহিনি মহন রায়য়ের ছেলে মৃত ফনি মহন রায় মৃত্যুকালে তার স্ত্রী মৃত উষা রানীসহ ৩ কন্যা ও ৬ ছেলে রেখে যান। তাদের পৈতৃক বাড়ি বড়বন্দর এলাকায়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ফনি মহন রায়য়ের মৃত্যুর পর কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ সড়যন্ত্র করে তাদের জমিজমা সব জবরদখল করে নেয়। এরপর থেকে শুরু হয় তাদেও কষ্টের জীবন।

ফনি মহন রায়ের ছেলে কানাই সাহা বলেন, তাদের বাবার মৃত্যুর পর জমিজমা বেদখল হয়ে যায়। এরপর তার বাবার মৃত্যুর কারণে দুশ্চিন্তায়-শোকে কিছুদিন পর তাদের মা উষা রানী মারা যান। এরপর শুরু হয় তাদের জীবনের করুণ পরিণতি।

কানাই রায় ও তার বড় ভাই দুলাল রায়, মধাব রায়, গোপাল রায় এবং তাদের বোন, শেফালী রানীসহ সকলেই বর্তমানে পূর্ব কাটাবাড়ী গ্রামে বসবাস করেন। কিছুদিন আগে ঝড়ের তোপে টিনের একটি ঘর ভেঙে পড়ে তাদের বোন জোসনা রানী মারা যান। তাদের আরও এক বোন অনিমা রায়কে তাদের বাবা বেঁচে থাকতে বিয়ে দিয়েছেন। সে শ্বশুরবাড়িতে থাকে, আর এক ভাই বালাই রায় বিয়ে করে অন্যত্র থাকে। ছোট ভাই শ্যামল রায়ও মারা গেছেন। বর্তমান তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এতই করুণ যে, আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় ভাঙা ঘরটিও মেরামত করতে পারছে না।

বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে তবুও বিয়ে করতে পারেনি তাদের এক বোন ও চার ভাই। যেখানে দু'বেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করাই কষ্টসাধ্য, বিয়ে করবে কীভাবে? কিছু কিছু দিন, কিছু কিছু বেলা তাদের না খেয়ে কাটে। পেটভরে খেতেও পায় না। তাদের অবস্থা এতই খারাপ যে, পরিবার-পরিজন নিয়ে প্রায়ই উপোস থাকতে হয়।

কানাই সাহা বলেন, তিনি আগে কাঁচামালের ব্যবসা করতেন। শারিরিক অসুস্থতার কারণে কয়েক বছর হলো ব্যবসা ছেড়ে দিতে হয়েছে। আগের মতো এখন আর তাদের পরিবারের কোনো আয়-রোজগার নেই।

স্থানীয়রা জানান, তাদের ভাই বোনদের মধ্যে এক বোন ও দুই ভাই বুদ্ধি প্রতিবিন্ধি হওয়ায় কোনো কাজ করতে পারে না। যে কারণে অনেক সময় পরিবার-পরিজন নিয়ে না খেয়ে তাদের জীবন কাটে। অভাবের সংসার ঠিকমতো খেতে না পাওয়ায়, সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায় বয়সের ভার ও অসুস্থতার কারণে বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।

গ্রামবাসীরা বলেন, কাঁচাবাজারে ব্যবসায়ীরা সবজি বাছাইয়ের পর যে নষ্ট সবজিগুলো ফেলে দেয়, অভাবের কারণে ফেলে দেয়া নষ্ট সবজিগুলো বাজার থেকে কুঁড়িয়ে নিয়ে এসে ওর মধ্যে থেকে বেছে বেছে কিছু সবজি রান্না করে এবং বাকিগুলো গরুকে খাওয়ায়।

তাদের বড়ভাই দুলাল রায় বলেন, কতোদিন যে এক টুকরা মাংস দাতে কাটিনি। কোনো কোনো সময় লজ্জা ভুলে সাহায্যের জন্য অন্যের কাছে হাত পাতেন তিনি। এভাবেই চলে তাদের জীবন। কানাই রায় ও তার ভাই বোনেরা প্রশাসন ও সমাজের বিত্তানদের কাছে সাহায্যের জন্য আকুল আবেদন জানিয়েছেন।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ইতোপূর্বে ঘর বরাদ্ধের তালিকা করা হয়েছে, যার বরাদ্ধ চলে এসেছে। এরকম পরিবারের যারা এই তালিকায় বাদ পড়েছে, পুনোরায় তাদের তালিকা করার ব্যাপারে বলা হয়েছে। পরবর্তিতে নির্দেশ এলেই তাদের ব্যবস্থা করা হবে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত