ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

সবক’টা জানালা খুলে দাও

  এম কে দোলন বিশ্বাস

প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:৩৩  
আপডেট :
 ১৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০২:৩২

সবক’টা জানালা খুলে দাও
প্রতীকী ছবি: সংগ্রহ।

সবক’টা জানালা খুলে দাও না

আমি গাইব, গাইবো বিজয়েরই গান।

ওরা আসবে চুপি চুপি,

যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ।

....

ওরা আসবে চুপি চুপি,

কেউ যেন ভুল করে গেয়ো না কো মন ভাঙা গান।

সবক’টা জানালা খুলে দাও না..।

এভাবে নানা গানে স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা অনুভূতি হয়ে উঠে এসেছে শিল্পীর সুললিত কণ্ঠে। স্বাধীনতার আলিঙ্গন করতে চাওয়া-পাওয়া প্রকাশ পেয়েছে বাহারি সুর-ছন্দে। বিশেষ করে পাকিস্তানিদের শোষণ, নিপীড়নের কবল থেকে বাঙালিদের স্বাধীনতার আহ্লাদ মিলে ডিসেম্বর মাসে।

আজ ১৬ ডিসেম্বর। বাঙালির পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির দিন। লাখো শহীদের রক্তস্নাত বিজয়ের বাঙালির গৌরবের বাঁধভাঙা আনন্দ আর লাখো স্বজন হারানোর শোকে ব্যথাতুর-বিহ্বল হওয়ারও দিন। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, নিপীড়ন আর দুঃশাসনের কুহেলিকা ভেদ করে ১৯৭১ সালের এই দিনটিতে বিজয়ের প্রভাতী সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে উঠেছিল বাংলাদেশের শিশির ভেজা মাটি।

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের পর ৪৯ বছর আগের এই দিনে আসে চূড়ান্ত বিজয়। যে অস্ত্র দিয়ে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী অন্তত ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে, কেড়ে নেয় দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম, ওই অস্ত্র তারা পায়ের কাছে রেখে নতজানু হয়ে একাত্তরের এদিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। আত্মপরিচয়ের ঠিকানা খুঁজে পায় স্বাধীনতাকামী বীর বাঙালি।

একাত্তরের ১৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন বাংলা প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয় ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে হানাদার বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবশেষে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনে বীর বাঙালির সাহসী সন্তানেরা। একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে দেখা দেয় স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। তাই কৃতজ্ঞ জাতি আজ দিনভর বর্ণাঢ্য আয়োজনে সশ্রদ্ধ বেদনায় স্মরণ করবে দেশের পরাধীনতার গ্লানি মোচনে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ করা বীর সন্তানদের। নতচিত্তে স্মরণ করবে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া শহীদদের।

একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল। কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের (বর্তমান শেকসপিয়ার সরণি) একটি দোতলা বাড়ি। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিবালয় আর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। বরাবরের মতো সেদিনও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কক্ষের দরজা একটু খোলা। উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী অভ্যাসবশে ডান হাতের আঙ্গুল কামড়াচ্ছেন। আনুমানিক সকাল ১০টায় তাজউদ্দীন আহমদের বিশেষ ফোনটি বেজে উঠল। ওই ফোনে গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছাড়া ফোন করতে পারেন না। কী কথা হলো বোঝা গেলো না। কিন্তু ফোন রেখে, চোখেমুখে সব পাওয়ার আনন্দ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানালেন, ‘সবাইকে জানিয়ে দাও, আজ আমরা স্বাধীন। বিকেল চারটায় আত্মসমর্পন’।

ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্বে আত্মসমর্পণ করে ৯১ হাজার ৫৪৯ হানাদার সেনা। বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের উপস্থিতিতে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জ্যাকবের তৈরি করা আত্মসমর্পন দলিলে সই করেন পাকিস্তানের পক্ষে লে. জেনারেল নিয়াজি এবং মিত্রবাহিনীর পক্ষে লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।

আর অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তেই বিশ্ববাসীকে অবাক করে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাঙালি জাতি পায় লাল-সবুজের একটি জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত এবং মানচিত্র। রক্তাক্ত পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধের এই বিজয় অর্জন ছিল ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি। আজ বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জনের দিন। জাতি গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করবে সেইসব শহীদকে; যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা।

আজ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের দিন। দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রাম করে বহু প্রাণ আর রক্তের বিনিময়ে এদিনে বাঙালি ছিনিয়ে আনে বিজয়ের লাল সূর্য। আজ পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় পুরো জাতি স্মরণ করবে মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী লাখো শহীদকে। যাদের জীবন উৎসর্গে আমরা পেয়েছি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। একই সঙ্গে প্রত্যয় ব্যক্ত হবে সমৃদ্ধ আগামীর বাংলাদেশ গড়ার।

বাঙালির বিজয়ের গৌরবগাঁথা ১৬ ডিসেম্বরে দখলদার পাকিস্তানের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম। এই গৌরবগাঁথায় যেমন আছে বিজয়ের আনন্দ, তেমনি আছে স্বজন হারানোর বেদনাও। কয়েকশ বছরের বিজাতীয় শাসন-শোষণের জগদ্দল পাথর সরিয়ে মুক্ত বাতাসে প্রাণভরে নিশ্বাস নেয়ার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল একাত্তরের এদিন। বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে এদিন বাংলার প্রতি ইঞ্চি জমি শত্রুমুক্ত হয়। একাত্তরের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলার দামাল ছেলেদের নিয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর আজকের দিনে পাকিস্তানি বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটায়।

প্রসঙ্গত, ১৯৪৭ সালে দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে এ অঞ্চলে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান নামে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। একটি থেকে হাজার মাইল ব্যবধানের মধ্যে আরেকটি। এ পৃথক দুই ভূখণ্ড নিয়ে সৃষ্ট পাকিস্তান ব্রিটিশ শাসনামলে প্রচলিত শোষণের চিরায়ত ধারা থেকে মুক্তি পেলো। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রটি সত্যিকারের স্বাধীনতা বঞ্চিত হয়ে রইল। পশ্চিম পাকিস্তান এদেশে শোষণ চালাতে থাকে। তারা বাঙালি গণমানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধ্বংস করার জন্য সুপরিকল্পিত চক্রান্তে মেতে উঠে।

পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সমৃদ্ধ ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবন ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার পরও বাঙালিদের ওপর বিজাতীয় উর্দু সংস্কৃতি গ্রহণ করতে বাধ্য করে। রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি হটিয়ে তারা সামরিক শাসন এবং নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাতে থাকে। এতে বাঙালি জাতি প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। রুখে দাঁড়ায় পাকিস্তানের সব অনাচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে। বাঙালি জাতির এ প্রতিবাদী চেতনা সহ্য করতে পারেনি পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে বাঙালিদের ওপর শোষণ ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাদের নির্যাতনের মাত্রা যতো বাড়তে থাকে বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রামও ততই বেগবান হয়।

এভাবে ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৮-৬৯ এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধের পথ ধরে ঊনসত্তরে বীর বাঙালি জাতি ফুঁসে ওঠে। এর মধ্যেই সংঘটিত হয় ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান। সেই গণআন্দোলনে পতন ঘটে সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুবের। কিন্তু বাঙালির অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হয়ে বরং আবারও ক্ষমতার দৃশ্যপটে আসেন আরেক সামরিক স্বৈরাচারী শাসক ইয়াহিয়া খান। আন্দোলনের পথ বেয়ে পাকিস্তানি শাসকরা বাধ্য হয় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন দিতে। ১৯৭০ সালে দেশে প্রথম অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে এ ভূখণ্ডের এবং বাঙালি গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও দেশ পরিচালনার ভার বঙ্গবন্ধুর হাতে না দিয়ে পাকিস্তানি শাসক চক্র ভিন্ন রকম চক্রান্তে মেতে ওঠে।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হলেও পরে তা স্থগিত করে দেয় পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া। ফলে বাঙালি প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করে। রাজপথে স্লোগান উঠে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। একাত্তরের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। শুরু হয় সারাদেশে গণমানুষের সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। এরপর সামরিক চক্র আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করে এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্র ও সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে থাকে বাংলাদেশে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গণহত্যা শুরু করে। এরপর সামরিক শাসকচক্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করলে তার অনুপস্থিতিতেই পূর্ব নির্দেশমতো হয় মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলায় গঠিত হয় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার। এরপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত করতে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রতিটি গ্রামে। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্রহাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে অপারেশন সার্চলাইট দিয়ে শুরু করে ৯ মাসে ওরা হত্যা করে ৩০ লাখ বাঙালিকে। লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম কেড়ে নেয়। একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর সেই অস্ত্রই পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে অপমানের গ্লানি মাথায় নিয়ে লড়াকু বাঙালির কাছে আত্মসমর্পণ করে ৯৩ হাজারের বিশাল বাহিনী। সেই থেকে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির বিজয় দিবস। এই মহান বিজয়ের ৪৯ বছর পূর্ণ হলো আজ।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনএম

  • সর্বশেষ
  • পঠিত