ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

ভেসে গেছে কয়েক হাজার ঘের, বিধ্বস্ত বহু ঘরবাড়ি

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২৭ মে ২০২১, ২০:০০  
আপডেট :
 ২৭ মে ২০২১, ২০:২৭

ভেসে গেছে কয়েক হাজার ঘের, বিধ্বস্ত বহু ঘরবাড়ি
ছবি- প্রতিনিধি

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আর পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে আতঙ্কে সময় কাটেছে উপকূলের লাখ লাখ মানুষের। ইয়াসের প্রভাবে অতি জোয়ার বা জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় ৯ জেলার ২৭ উপজেলার মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতি জোয়ার বা জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় বহু এলাকা বিধ্বস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে হাজার হাজার মাছের ঘের। বিধ্বস্ত হয়েছে বাঁধ, বাড়িঘর থেকে শুরু করে বহু গাছপালা। বাংলাদেশ জার্নালের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে রিপোর্ট:

বাগেরহাটে ভেসে গেছে ৫ হাজার চিংড়ি ঘের, ভেসে এলো ৪ মৃত হরিণ:

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও জোয়ারের পানির প্রভাবে উপকূলীয় বাগেরহাটে ভেসে গেছে ৫ হাজার চিংড়ি ঘের। এতে জেলার মাছ চাষিরা প্রায় ৫ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে। বুধবার ও বৃহস্পতিবার জোয়ারের পানিতে এসব মাছের ঘের ভেসে যায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলার রামপাল, মোংলা, মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলর মাছ চাষিরা। এসব উপজেলার চিংড়ি চাষিরা নেট ও পাটা দিয়ে ঘের রক্ষার শেষ চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে জেলা মৎস্য বিভাগ বলছে, জোয়ারের পানি আরও বৃদ্ধি পেলে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান আরও বৃদ্ধি পাবে।

বাগেরহাট মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলার রামপাল উপজেলায় ৪ হাজার ৮৩৭টি, মোংলায় ৫ হাজার ৬০১টি, শরণখোলায় ১ হাজার ৩৪২টি ও মোরেলগঞ্জ উপজেলায় চিংড়ি ঘের রয়েছে ৯ হাজার ৯২০টি। এর মধ্যে চিংড়ি ও সাদা মাছের ঘের ভেসে গেছে প্রায় ৫ হাজার। বাগেরহাট জেলায় ৭১ হাজার ৮৮৬ হেক্টর জমিতে ৮১ হাজার ৩৫৮টি বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। আর চিংড়ি চাষি রয়েছে ৭৯ হাজার ৭৩৬ জন।

রামপাল উপজেলার হুকরা গ্রামের বাসিন্দা মনোরঞ্জন ঢালি বলেন, গতকাল পানিতে আমার ১২ বিঘার তিনটি ঘেরের মধ্যে দুটি পুরোপুরি ভেসে যায়। একটি আংশিক ডুবে ছিলো। নেট ও পাটা দিয়ে ঘেরটি রক্ষার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সেটিও আজ ভেসে গেছে। এতে আমার ৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমার মতো অন্যান্য ঘের মালিকও তাদের ঘের রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে, তবে জোয়ারের পানির তরে অধিকাংশ ঘেরই ভেসে গেছে।

বাগেরহাটে ভেসে গেছে ৫ হাজার চিংড়ি ঘের

শরণখোলা উপজেলার তাফালবাড়ী এলাকার মিজান গাজী বলেন, ‘মুই গরীব মানুষ ভাই। এনিজও ও এলেকার বিভিন্ন মানুর কাছ থাইক্কা টাহা-পয়সা ধার দেনা কইরা ৩ বিঘার দুইডা ঘের করছেলাম। এই ঘেরে টাহায় মোর সংসার চলে। মুই তো পথের ফহির হইয়া গেলাম। বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।’ মোরেলগঞ্জের জিউধরা ইউনিয়নের নিশানবাড়ীয়া গ্রামের আফজাল শরীফ বলেন, ‘ভাই মোগো এইহানে এহন আর মোর আর তার নাই, সব এহন সমান। নেট-পাটা দিয়াও ঘের রাখতে পারি নাই, সব ডুইব্বা গেছে। কাইলগোর থাইকা আইজগো পানি আরও বাড়ছে।’

বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম রাসেল বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বাতাস ও জোয়ারের পানির প্রভাবে জেলার রামপাল, মোংলা, মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলার প্রায় ৫ হাজার চিংড়ি ও সাদা মাছের ঘের ভেসে। প্রাথমিকভাবে আমরা ধারনা করছি, এতে প্রায় ৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে এমন অবস্থা চলতে থাকলে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান আরও বাড়বে।

অন্যদিকে সুন্দরবন থেকে জোয়ারের পানিতে একে একে লোকালয়ে ভেসে এসেছে ৪টি মৃত ও দুটি জীবিত হরিণ। পানিতে ডুবে সুন্দরবনের আরও বন্যপ্রাণী মারা যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছে বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ। বুধবার ও বৃহস্পতিবার সুন্দরবনের কচিখালী অভয়ারণ্য ও দুবলার চর থেকে দুটি এবং শরণখোলা উপজেলার সাউথখালি ইউনিয়নের তাফালবাড়ি গ্রাম থেকে একটি ও রায়েন্দা ইউনিয়নের রাজেশ্বর গ্রাম থেকে একটি মৃত হরিণ উদ্ধার করে বনবিভাগ। এছাড়া বাগেরহাটের পার্শবর্তী মঠবাড়িয়া উপজেলা থেকে দুটি জীবিত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে।

সুন্দরবন থেকে ভেসে এসেছে ৪টি মৃত হরিণ, আরও প্রাণী হতাহতের শঙ্কা

বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের করমজল বণ্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও জোয়ারের পানির প্রভাবে ৫ থেকে ৬ ফুট পানির নিচে করমজল বণ্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে তলিয়ে গেছে। এর প্রভাবে বনের অভ্যান্তরে লবণপানি প্রবেশ করছে। এছাড়া সকাল থেকে আমি বনের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছি। এর মধ্যে বনের বিভিন্ন উঁচু স্থানে আমি বন্য শুকর ও হরিণ আশ্রয় নিতে দেখেছি। প্রজনন কেন্দ্রে কুমিরের সেডগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সুন্দরবনে এতো পানি আমি আগে কখনো দেখিনি। এমন অবস্থায় সুন্দরবনের বণ্যপ্রাণী আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে প্রায় ৫-৬ ফুট পানি উঠে যায় সুন্দরবনে। এর ফলে পানিতে ডুবে বণ্যপ্রাণী মারা যাচ্ছে। এরই মধ্যে ৪টি মৃত ও দুটি জীবিত হরিণ আমরা উদ্ধার করেছি। পানির তোড় ও ঝড়ো হাওয়ায় পূর্ব সুন্দরবনের ১৯টি জেটি, ৬টি জলযান (ট্রলার) দুটি গোলঘর, একটি ওয়াচ টাওয়ার, চারটি স্টাফ ব্যারাক ও একটি রেস্টহাউজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্তত ৬টি অফিসের টিনের চালা উড়ে গেছে বলে প্রাথমিকভাবে আমরা জানতে পেরেছি। ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণের জন্য রেঞ্জে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ক্ষয়-ক্ষতির পরিমণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।

সাতক্ষীরায় দুর্ভোগ বাড়ছে, নুতন নতুন এলাকা প্লাবিত, ভেসে গেছে বহু মাছের ঘের:

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও জোয়ারের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছাসের দ্বিতীয় দিনেও প্লাবিত হয়েছে সাতক্ষীরা উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার নতুন নতুন এলাকা। উপকূল রক্ষা বাঁধের ভাঙনকবলিত অংশ দিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় এসব এলাকা প্লাবিত হয়।

এদিকে আগের রাতে ভাটার টান ও বৃহস্পতিবার দুুপুরের জোয়ারের তোড়ে ৫, ১৫ ও ৭(১) নং পোল্ডারের আরও ১৫টি পয়েন্টে বাঁধ নুতন করে নদীতে বিলীন হয়েছে। গাবুরা ও কৈখালীর একটি করে পয়েন্টের বাঁধ স্থানীয়রা বাঁধতে সমর্থ্য হলেও ইউনিয়ন দুটির আরও সাতটি পয়েন্ট নিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকাকে ভাসিয়ে দিয়েছে। এসব অংশ দিয়ে নদীর সাথে সমানতালে লোকালয়ে জোয়ার-ভাটা চলতে থাকায় সমগ্র এলাকাজুড়ে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে।

বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্টে ভেঙে সাতক্ষীরায় হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি

হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ার পাশাপাশি বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পরিবারগুলোতে পানীয় জলসহ তীব্র খাবারের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে তা উপদ্রুত এসব এলাকার লক্ষাধিক জনগোষ্ঠীর জন্য নিতান্ত অপ্রতুল হয়ে পড়েছে। বাড়িঘর ভেসে যাওয়ার কারণে দুর্গত এসব মানুষের অধিকাংশই বুধবার জলোচ্ছাসের পর থেকে এক কাপড়ে দিনাতিপাত করছে। পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে অনেকে আবার কয়েকবেলা অভুক্ত অবস্থায় থেকেও ধ্বংসযজ্ঞে পরিনত হওয়া বাড়িঘরের মালামাল সরানোর কাজ করছে।

জলোচ্ছাসে প্লাবিত শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী, গাবুরা ও বুড়িগোয়ালীনির বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও স্থানীয়দের কথা বলে এমন চিত্রের দেখা মিলেছে। স্থানীয়রা জানিয়েছে, বুধবার দুপুরের জলোচ্ছাসের পর বিকালের দিকে পানি নামতে শুরু করলেও ধীরে ধীরে তাদের দুর্ভোগ বাড়তে শুরু করেছে। খাবার ও পানীয় জলসহ রোদ-বৃষ্টির মধ্যে তারা রীতিমতো মাথা গোঁজার জায়গার তীব্র সঙ্কটে রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, জলোচ্ছাসের কারণে চিংড়ি ঘেরসহ বাড়িঘর, মিষ্টি পানির পুকুর আর রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় গোলাখালীসহ কৈখালী ও গাবুরার বিভিন্ন অংশ অনেকটা যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদে রূপ নিয়েছে। রাস্তাঘাট ও উপকূল রক্ষা বাঁধ ভেঙে অংনেকাংশে সরু আইলের সৃষ্টি হওয়ার কারণে উপজেলা সদরের সাথে সড়কপথে এসব এলাকার যোগাযোগ রক্ষা দুরুহ হয়ে পড়েছে।

পদ্মপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে জোয়ারের পানি পাতাখালী এলাকার উপকূল রক্ষা বাঁধ উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করায় ছোট পাতাখালী, ঝাঁপালী ও কামালকাটিসহ পদ্মপুকুর ইউনিয়নের আরও সাতটি গ্রামকে প্লাবিত হয়েছে। এ সময় জোয়ারের পানির চাপে ঝাপা অংশের প্রায় পঞ্চাশ মিটার বাঁধ খোলপেটুয়া নদীতে বিলীন হয়।

শাহিন বিল্লাহ নামের স্থানীয় এক তরুণ জলবায়ু এক্টিভিস্ট জানান, বুধবার ছাপিয়ে ও ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করলেও বৃহস্পতিবার নাগাদ এসব অংশে বড় বড় খালের সৃষ্টি হয়েছে। আগেরদিন ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হলেও বৃহস্পতিবার দুপুরের পর ইউনিয়নের মাত্র দুটি গ্রাম প্লাবিত হতে বাকি রয়েছে।

বুড়িগোয়ালীনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভবতোষ মন্ডল জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরের জোয়ারের পানি ঢুকে বুড়িগোয়ালীনি, চুনা, কলবাড়ীসহ তার ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রাম নুতন করে প্লাবিত হয়েছে।

ভাঙা বাঁধ মেরামতের চেষ্টায় স্থানীয়রা

আম্পানের পর দাতিনাখালী অংশের বাঁধ সংস্কারের সময় মাটির নিচে বালু দেয়া হয়। বারবার আপত্তি তোলার পরও ঠিকাদারসহ কতৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নেয়নি। পরবর্তীতে বৃহস্পতিবারের জোয়ারের তোড়ে সংলগ্ন এলাকাসহ আরও চারটি অংশের বাঁধ ধসে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো প্লাবিত হওয়ায় কাঁকড়া ও চিংড়ি প্রকল্প ভেসে গেছে।

কৈখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম জানান, সীমান্তবর্তী কালিন্দি নদী তীরবর্তী জয়াখালী এলাকার বাঁধ ভেঙে বৈশখালী, জাদা, পরানপুরসহ কৈখালীর অপরাপর অংশে বৃহস্পতিবার দুপুরেও জোয়ারের পানি প্রবেশ করেছে।

সংবাদকর্মী মনির হোসেন ও ফজলুল হকসহ স্থানীয়রা জানায়, জোয়ারে পানি ঢুকলেও তা নিষ্কাশনের সুযোগ না থাকায় তারা পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পরিবারের নারী, বৃদ্ধ ও শিশুদের পার্শ্ববর্তী সাইক্লোন শেল্টারে উঠিয়ে দিয়ে তারা বাড়িঘর পাহারা দিচ্ছেন বলেও জানান।

বিস্তীর্ন এলাকার কাঁচা-পাকা রাস্তায় ব্যাপক ধস লেগেছে

সরেজমিনে দেখা যায়, বুধবার দুপুরে ভাটার টানে লোকালয় থেকে পানি নেমে যাওয়ার সময় মুন্সিগঞ্জের সিংহড়তলী ও কৈখালীর কাঠামারীসহ বিস্তীর্ন এলাকার কাঁচা-পাকা রাস্তায় ব্যাপক ধস লেগেছে। পানি নেমে যাওয়ায় হেলে পড়া ঘরবাড়ি রক্ষায় অনেকে বাঁশ খুটি দিয়ে ঠেকা (হেলান) দিয়েছে।

প্লাবিত অংশের মানুষজন জানিয়েছে, ভাটায় পানি নেমে গেলেও জোয়ারে আবার বসতঘর পর্যন্ত তলিয়ে যাচ্ছে। তারা চরম দুর্দশার মধ্যে প্রতিটি মুহূর্ত কাটাচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে বাঁধের ভাঙন আটকানোর দাবি জানায় তারা।

উপজেলা প্রশাসন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির তরফে জানানো হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস'র প্রভাবে শ্যামনগর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের সবগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৈখালী, গাবুরা সম্পুর্নভাবে বিধ্বস্থ হলেও অপরাপর ইউনিয়নগুলো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। প্রশাসনের দাবি, ইয়াস'র প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছাসে উপজেলার ৪৭৬৫টি বসতবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এছাড়া ৫০ হাজার মানুষ দুর্গত হলেও কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।

জরুরি প্রয়োজনীয় পানীয় জল, তৈরি খাবার ও পোশাকসহ জরুরি আশ্রয়ের আবশ্যকতা রয়েছে বলেও প্রশাসন সূত্র নিশ্চিত করেছে। এছাড়া জীব-জন্তুর কোনো ক্ষতি না হলেও ১৬৫০ হেক্টর জমির চিংড়ি ঘের ও ৯০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।

পটুয়াখালীতে দুই মৃত্যু, বন্দিদশায় লাখ লাখ মানুষ:

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে সৃষ্ট অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে ডুবে পটুয়াখালী জেলায় নারীসহ এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে দুমকি উপজেলার মুরাদিয়া ইউনিয়নের সন্তোষদি গ্রামের হাফেজ হাওলাদারের স্ত্রী হাসিনা আক্তার (৫৫) বিল থেকে গরু আনতে গিয়ে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে ডুবে মারা যান। একইদিন দুপুরে কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নের নাচনাপাড়া গ্রামের ফরিদ হাওলাদারের শিশুকন্যা ছায়েবা (৯) গোসল করতে গিয়ে জোয়ারের পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করে।

হাসিনা আক্তারের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রশাসক মতিউল ইসলাম চৌধুরী। আর কলাপাড়ার টিয়াখালীতে শিশুর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট টিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ মশিউর রহমান শিমু।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের তাণ্ডবে জেলায় ৪৮৪টি কাঁচা ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং ৪২০৯টি কাঁচা ঘর আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। ইয়াস মোকাবেলায় জেলায় এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ, শিশু ও গো-খাদ্যের জন্য ২ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা প্রথমিকভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া চাল, ডাল, আলু, লবণ, তেল সম্বলিত ৩ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার প্যাকেট বরাদ্দের কথা জানিয়েছেন জেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ কর্মকর্তা রনজিৎ কুমার সরকার।

ইয়াস আর পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে বহু ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত

ইয়াসের প্রভাব অনেকটা কেটে গেলেও পূর্ণিমার প্রভাবে রাবনাবাদ নদীর পানি প্রবেশ করে কলাপাড়ার লালুয়া ইউনিয়নের ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ধানখালী ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ ভেঙে ৩ গ্রাম, মহিপুর ইউনেয়নের ৩ গ্রাম, চম্পাপুর ইউনিয়নের ৪ গ্রাম ও টিয়াখালীর নাচনাপাড়া এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। অস্বাভাবিক জোয়ারের তোড়ে আরো বেশ কয়েকটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। জোয়ারের পানির চাপে যে কোনো সময় বাঁধ ছুটে প্লাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।

কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হালিম সালেহী বলেন, আজ বৃহস্পতিবার সকালেও কলাপাড়ার আন্ধারমানিক, টিয়াখালী, খাপড়াভাঙ্গা ও রাবনাবাদ নদীর পানি বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালের জোয়ারে কুয়াকাটা সৈকতের ব্লক পয়েন্টেরর নিচ খেকে থেকে প্রায় পাঁচ ফুট মূল বাঁধের রিভার সাইড ভেঙে গেছে। সাগরের বিক্ষুব্ধ ঢেউয়ের তাণ্ডবে সরে গেছে সৈকত রক্ষার কয়েকটি ব্লক। প্রচণ্ড ঢেউয়ের তোড়ে সৈকতের প্রায় দেড় ফুট বালু ক্ষয় হওয়ায় লেম্বুর বন, গঙ্গামতি ও কুয়াকাটা ইকোপার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে কলাপাড়া ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, ইয়াস আতঙ্ক কেটে গেলেও পূর্ণিমার জো’র প্রভাবে সৃষ্ট মেঘমালার কারণে থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। পায়রা সমুদ্রবন্দরকে আজও ৩ নম্বর সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

জোয়োরের পানিতে বন্দিদশায় দিন কাটাচ্ছে বহু মানুষ, জ্বলছে না রান্নার চুলা

এদিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত পটুয়াখালী উপকূলের লাখো মানুষ যখন অস্বাভাবিক জোয়োরের পানিতে বন্দিদশায় দিন কাটাচ্ছে, রান্নার চুলা জ্বলছে না- তখন কখনও নৌকায় আবার কখনও হাঁটু পানিতে নেমে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র পক্ষে ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছেন সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ মো. মহিব্বুর রহমান। ইয়াস আতঙ্ক কেটে গেলেও জোয়ারের পানিতে বাড়িঘর তলিয়ে থাকা মানুষের কাছে তিনি এখন মানবতার ফেরিওয়ালা।

বৃহস্পতিবার দিনভর সংসদ সদস্য মহিব্বুর রহমান কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নের নিশানবাড়িয়া, গন্ডামারি, চম্পাপুর ইউনিয়নের দেবপুর বেড়িবাঁধ ঘাট, বাংলাবাজার, মহিপুর ইউনিয়নের নিজামপুর, ধূলাসার ইউনিয়নের চাপলিবাজার, লতাচাপলি ইউনিয়নের খাঁজুরা, কুয়াকাটা, লালুয়া ইউনিয়নের চারিপাড়া, চান্দুপাড়া এবং রাঙ্গাবালী উপজেলার ছোটবাইশদিয়া, বড় বাইশদিয়া, চালিতাবুনিয়া, রাঙ্গাবালী সদর, ও চরমোন্তাজ ইউনিয়নের বানভাসি মানুষের মাঝে ৫ কেজি চাল, ১ কেজি ডাল, ১ লিটার তেল, ১ কেজি আলু ও ১ প্যাকেট লবণ সম্বলিত ২১০০ প্যাকেট খাদ্য সহায়তা প্রাথমিকভাবে বিতরণ করেছেন।

ঝালকাঠিতে ৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত, ভেসে গেছে ৩ কোটি টাকার মাছ:

ঝালকাঠিতে আবহাওয়া পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করেছে। নেমে যেতে শুরু করেছে নিম্মাঞ্চলের পানি। সেইসাথে ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র ফুটে উঠছে। প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, জেলায় ৩.৭৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে ২ হাজার ১৩৯টি পুকুর, দিঘী ও খামারের মাছ।

জেলা মৎস বিভিাগ জানিয়েছে, ১৩৫ মেট্রিকটন মাছ এবং ৩১ লাখ ৫৩ হাজার মাছের পোনা ভেসে গেছে। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩ কোটি টাকা।

এদিকে ঝালকাঠি সদর উপজেলার চরভাটারাকান্দা, চরকুতুবনগর, নলছিটির বাড়ইকরণ ও কাঁঠালিয়া সদর ইউনিয়নসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার প্রায় চার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব হোসেন বলেন, ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জেলার বেড়িবাঁধগুলোর ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে প্রতিবেদন আকারে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে। সেখান থেকে বরাদ্ধ পাওয়া মাত্রই আমরা কাজ শুরু করব।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কান্তি ঘোষ বলেন, জেলার মৎস্য চাষিদের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণ করে বিভাগীয় অফিসে প্রেরণ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে কোনো উপকরণ পেলে তা মৎস্য চাষিদের মাঝে বিতরণ করা হবে।

কক্সবাজারে বহু গ্রাম প্লাবিত, মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্লাবিত হয়েছে, বিলীন হচ্ছে ঝাউবাগান:

ইয়াসের প্রভাবে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই কক্সবাজার সংলগ্ন উপকূলে ঝোড়ো হাওয়া বইছে। কোথাও কোথাও আকাশ মেঘলা, কোথাও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বঙ্গোপসাগর উত্তাল রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আতঙ্ক কেটে গেলেও জলোচ্ছ্বাস মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকালের জোয়ারে জেলার পাঁচটি উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার ১২১টি গ্রামের অন্তত ৩ হাজার ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ২৩০টি বসতবাড়ি।

অন্যদিকে আগের রাতের জলোচ্ছ্বাসে এসব গ্রাম থেকে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হয়েছিল। মাত্রাতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের বালুচর ডুবে মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্লাবিত হয়েছে, বিলীন হচ্ছে ঝাউবাগান। জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ জানিয়েছেন, দুদিনের জলোচ্ছ্বাসে জেলার বিভিন্ন উপকূলে ২ হাজার ৫৭০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেড়িবাঁধেরও ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলছে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত