ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

সিনেমার চেয়েও বেশি ট্র্যাজেডি যে জীবনে

  আবুল হোসেন, গাজীপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২১, ১৭:২০  
আপডেট :
 ০১ অক্টোবর ২০২১, ২২:১১

সিনেমার চেয়েও বেশি ট্র্যাজেডি যে জীবনে
আমেনা বেগম

১০ বছর বয়সে তার নাম ছিল কৃষ্ণা ব্যানার্জী। এখন তিনি ৬১ বছরের আমেনা বেগম। ঢাকায় এক সরকারি অফিসের অডিট অফিসার ছিলেন তিনি। প্রায় এক বছর আগে চাকরি থেকে অবসরে যান। তার খুব আশা ছিল দুই মেয়ে আর নাতি-নাতিদের সঙ্গে নিয়ে সুখেই কাটাবেন বাকি জীবন। কিন্তু চাকরিজীবনের সঞ্চিত টাকার ভাগাভাগি নিয়ে মেয়েদের মধ্যে মনোমালিন্য আর কলহের জেরে এখন তার ঠাঁই হয়েছে গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। জীবনের বাকি সময়টুকু তিনি এখন এ আশ্রমে কাঁটাতে চান।

সুখের সংসার থেকে কিভাবে এই আশ্রমে ঠাঁই হলো তার, এসব বলতে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি বৃদ্ধা আমেনা।

মানিকগঞ্জের ঘিওরের ত্বরা এলাকায় কৃষ্ণার বাবার ছিল বিঘায় বিঘায় সম্পত্তি। ব্রাহ্মণ ধর্মে দীক্ষিত পাঁচ ভাইয়ের মাঝে সবচেয়ে ছোট বোন হিসেবে আদরের কমতি ছিল না তার। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার বয়স ১০ বছর। হঠাৎই পাক হানাদার বাহিনী তাদের বাড়িতে গিয়ে বাবা-মাকে ইন্দারায় (অন্ধকার কুয়ায়) ফেলে ও চার ভাইকে গুলি করে হত্যা করে। বড় ভাই মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে নিখোঁজ ছিলেন।

এরপর স্বজন হারিয়ে শিশু কৃষ্ণার জায়গা হয় হাফিজ উদ্দিন নামের এক কুরআনের হাফেজের ঘরে। মুক্তিযুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর বড় ভাই ফিরে আসলেও মুসলিম বাড়িতে পালিত হওয়ায় যুদ্ধফেরত ভাই তাকে আর নেননি। একসময় ভাইও লাপত্তা হয়ে যান। আর চাচারা সম্পত্তির লোভে ব্রাহ্মণ পরিবারে ফিরিয়ে নেননি তাকে।

একসময় ধর্মান্তরিত হয়ে কৃষ্ণার নাম হয় আমেনা। এরপর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে তাকে ঢাকার একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করান হাফিজ উদ্দিন। পরে তিনি ১৯৮১ সালে দাখিল ও পরে আলিম পাশ করেন। সে বছরেই বদিউল আলম নামের এক মসজিদের ইমামের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ও পাশাপাশি তিনি কুরআনের হাফেজ হন। পরপর তার দুই মেয়ের জন্ম হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্বামীকে হারান।

মৃত্যুশয্যায় স্বামী তার হাত ধরে লেখাপড়া চালিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরামর্শ দেন। স্বামীর কথামতো তিনি লেখাপড়া করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে দীর্ঘদিন সরকারের উচ্চপদে দায়িত্ব পালন শেষে গত বছর অবসরে যান তিনি।

মাত্র ১০ বছর বয়স থেকে সংগ্রাম করে আসা এই ভাগ্যবিড়ম্বিত নারী নিজের উপার্জিত অর্থে দুই মেয়েকে মানুষ করেছেন। মেয়েদের উজ্জল ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে বহুতল বিশিষ্ট বাড়িও করেছেন ঢাকার কেরানীগঞ্জে। সন্তানদের করেছেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত, বিয়েও দিয়েছেন। আলাদা আলাদা বাড়িতে মেয়েরা সুখেই ছিল।

কয়েক বছর আগে হঠাৎ করে তার ছোট মেয়ের স্বামী মারা যান। পরে মেয়ে ও নাতনিদের তিনি তার বাসায় নিয়ে আসেন। নাতনিদের নিয়ে ভালোই কাটছিল অবসরের দিনগুলো। তাদের সাথেই শেষ দিন পর্যন্ত কাটানোর ইচ্ছা ছিল।

কিন্তু অর্থের জন্য মেয়েরা আমেনার সাথে দুর্ব্যবহার করতে থাকে। নিজের সঞ্চয়ের ৫৫ লাখ টাকা ছিল ব্যাংকে গচ্ছিত। তার অসুস্থতার সুযোগে এটিএম কার্ড ও পিন নাম্বার নিয়ে কয়েক দফায় পুরো টাকা উঠিয়ে নেন তার বড় মেয়ে। এরপরও ছোট মেয়ে প্রতিনিয়তই টাকার জন্য তার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে থাকে। মেয়ের এমন আঁচড়ে দাগ কেটে যার তার মনে। তার প্রতিটি কাজেই বাধা হয়ে দাঁড়ান তার ছোট মেয়ে।

একদিন খাবারের সময় হলে ধাক্কা দিয়ে তার সামনে খাবারের প্লেট দেন মেয়ে। বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি তিনি। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আশা ক্ষীণ হয়ে যায় তার। আত্মহত্যারও সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ঘরে বাস করে তার নাতি-নাতনি। তারা ভয় পাবে, আর হয়তো তারা এ ঘরে বাস করবেন না, এসব ভেবে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন তিনি।

গত ১৩ মার্চের এক রাতে বাসার মূল ফটকের চাবী নিয়ে নেন নিজের কাছে। দৈন্দিদিন প্রয়োজণীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে সবার অগোচরে ১৪মার্চ ভোরে বাসা থেকে বেরিয়ে আসেন। দরজার নিচ দিয়ে ভেতরে গেটের চাবি ভেতরে ছুড়ে রেখে আসেন। বন্ধ করে দেন ব্যবহৃত মুঠোফোন। চলে আসেন গাজীপুরের বৃদ্ধাশ্রমে।

আমেনা জানান, তার জীবনলিপি হয়তো সৃষ্টিকর্তা ভিন্নভাবেই লিপিবদ্ধ করেছেন। বাঁকে বাঁকে মোড় নিয়েছে অতিবাহিত হওয়া সময়গুলো। কত কষ্ট করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সন্তানদের মানুষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘জীবনের শেষ সময়ে তাদের দূর্ব্যবহারগুলো মেনে নিতে পারিনি। অর্থের জন্য নিজের মায়ের সাথে এমন আচরণ কি ভোলা যায়? তাই তাদের সুখের কথা বিবেচনা করেই তাদের কাছ থেকে দূরে সরে এসেছি। অন্তত তারা যেন ভালো থাকে। মৃত্যু পর্যন্ত এমন আশীর্বাদ থাকবে তাদের জন্য।’

গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে কথা হয় আমেনার সঙ্গে। জীবনের এ চরম বাস্তবতাগুলো বলতে বলতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না। তারপরও তিনি এখানে ভালো আছেন বলে জানান। এখানে সংসারের কোনো ঝামেলা নেই। ঠিক সময়ে খাওয়া-দাওয়া, গোসল, টিভি দেখে, অন্য নিবাসীদের সঙ্গে গল্প করে, লুডু খেলে, খবরের কাগজ পড়ে সময় কাটছে তার। তার জীবনের শেষ ইচ্ছা, এখানেই যেন তার বাকি সময়টা কাটে। এখানে তিনি ভালো আছেন।

প্রতিষ্ঠানের সহকারী ব্যবস্থাপক হাবিবা খন্দকার বেলী জানান, ১৯৮৭ সালে ঢাকার উত্তরার আজমপুরে ৮ কক্ষের পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলেন গিভেন্সি গ্রুপের কর্ণধার খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল। পরে ১৯৯৫ সালে তিনি গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়া মনিপুর এলাকায় বড় পরিসরে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখানে নারী ও পুরুষ নিবাসীদের জন্য অলাদা বাসস্থান, চিকিৎসার জন্য মেডিকেল সেন্টার, চিত্তবিনোদনের জন্য টেলিভিশন, কেরাম, লুডু-দাবাসহ নানা সামগ্রী রয়েছে।

এছাড়া এখানকার জমিতে চাষ হচ্ছে ধানসহ বিভিন্ন ফসল, পুকুর মাছ চাষও হচ্ছে। রয়েছে একটি বেকারিও। এখানকার উৎপাদিত খাদ্যসামগ্রী নিবাসীদের সরবরাহ করা হয়। বর্তমানে এখানে ৭৬ জন পুরুষ ও ৫৭ জন নারী রয়েছেন। তাদের অনেকেরই সন্তান দেশের বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত।

বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল বলেন, যাদের ৬০ বছর বা তদুর্ধ্বে এবং যারা চলাচলে সক্ষম, তারা বিনামূল্যে এ কেন্দ্রের নিবাসী হওয়ার সুযোগ পান। এখানে তাদের বিনামূল্যে খাবার ও কাপড়-চোপড় দেয়া হয়। এখানে যার যার ধর্ম পালনের সুযোগ রয়েছে। কেউ চাইলে এখানেই যার যার ধর্মের রীতি অনুযায়ী দাফন/সৎকারের ব্যবস্থা করা হয়।

মুকুল আরও বলেন, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের অনেকেই সামাজিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেছি। যে পিতা-মাতার অপরিসীম ত্যাগ তিতিক্ষার ফলে সন্তান সমাজে প্রতিষ্ঠিত, সেই সন্তান অনেক সময় তার বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে অবজ্ঞা করছে, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে। তেমনি অনেক অসহায় বাবা ও মা শেষ জীবন এখানে কাটাচ্ছেন। তাদের সবার জীবনের গল্পটা কষ্টের। আমরা আশাবাদী মানুষ, নতুন প্রজন্মের কাছে প্রত্যাশা থাকবে কোনো বাবা ও মায়ের স্থান যেন বৃদ্ধাশ্রমে না হয়।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত