ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

মেরে ‘মৃত ভেবে’ কাঁটাতারে ফেলে যায় মামারা

তিন বছর পর বেঁচে ফেরার লোমহর্ষক গল্প

  এম. এ. কাইয়ুম, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:৫৮  
আপডেট :
 ০৫ ডিসেম্বর ২০২১, ১৭:০১

তিন বছর পর বেঁচে ফেরার লোমহর্ষক গল্প
ভুক্তভোগী শাহাজাহান

মায়ের ভাই মামা। মায়ের মমতার পর আদর-আহ্লাদের আরেক ঠিকানা হলো মামাবাড়ি। কিন্তু নির্মম পৈশাচিক নির্যাতন করে সেই মামারাই আপন ভাগ্নেকে হত্যার চেষ্টা করেছে। ভাগ্য সহায় থাকায় এক বছরের অধিক সময় কোমায় থেকেও বেঁচে আছে ভাগ্নে শাহাজাহান।

প্রায় তিন বছর পর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মডার্ন সাইক্রিয়াটিক হাসপাতাল থেকে প্রশাসনের মাধ্যমে বাংলায় ফিরে লোমহর্ষক সেই হত্যাচেষ্টার বর্ণনা দিলেন শাহাজাহান। এক হাত এক কান চিরতরে হারিয়ে আচমকা ভয়ে এখনও তটস্থ থাকে সে। কথা বলায় জড়তা থাকে মাঝে মধ্যে আৎকে ওঠে অজানা আতঙ্কে।

কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের ডরিতাজপুর গ্রামের মানিক মিয়ার ছেলে শাহাজাহান। ২০ বছর বয়সী শাহাজাহান কৃষিকাজ করতো। তার মায়ের সাথে বাবার বনিবনা না হওয়ায় সংসারে বিরোধ দেখা দেয়। সে বাবার পক্ষাবলম্বন করে, আর এ কারণেই মামা ওয়াছির মিয়া, ফুরকান মিয়া, মবশ্বির মিয়া, ইয়াছিন মিয়া ভাগ্নে শাহাজাহানের ওপর চরম ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে প্রাণে মারার পাঁয়তারা শুরু করে।

শাহজাহান জানায়, ঘটনার দিন ২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি। টিলাগাঁও কামালপুর হয়রত শাহ ফয়জুল হক চিশতীর মাজারে ওরস মাহফিলে গেলে রাত আনুমানিক ২টার দিকে মামা ইয়াছির মিয়া গোপন কথা বলবেন বলে রাস্তায় নিয়ে যায় শাহজাহানকে। সেখানে আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা সিএনজিচালিত অটোতে অন্য মামাদের সহযোগিতায় জোরপূর্বক তুলে নির্জন স্থানে নেয়া হয়। সেখানে নিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে তাকে।

ওই সময় মামা ফুরকান মিয়া বটি দা দিয়ে শাহাজানের ঘাড়ে আঘাত করলে সে একটু কাঁত হয়ে যায়। সেই কোপ ঘাড়ে না লেগে তার ডান হাত কাঁধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মামা ওয়াছির হাতে থাকা ‘খাসি দা’ দিয়ে মাথায় কোপ দিলে বাম কানসহ মাথার কিছু অংশ কেটে শরীর থেকে খসে পড়ে যায়। এরপর মামা মবশ্বির ও ইয়াসিন ছুরি দিয়ে শাহাজাহানের বুকে ও হাতে কোপায়।

উপর্যুপরি সংবদ্ধ আঘাতে ক্ষতবিক্ষত শাহাজাহান এক সময় নিথর হয়ে পড়ে। মামারা তাকে মৃত ভেবে শরীফপুর ইউনিয়নের চাতলাপুর সীমান্তে কাঁটাতারের ভেতরে ভারত অংশে ফেলে রেখে দেয়। ওইদিন সকালে সীমান্ত এলাকায় টহলরত বিএসএফ শাহজাহানকে উদ্ধার করে কৈলাশহর হাসপাতালে ভর্তি করে।

প্রায় এক বছর কৈলাশহর হাসপাতালে আইসিউতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে শাহাজাহান। পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ত্রিপুরা রাজ্যের মডার্ন সাইক্রিয়াটিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত চিকিৎসাধীন ছিলো সে।

চিকিৎসাধীন থাকাকাকে জ্ঞান ফিরলে এক নার্সকে ঘটনার বিস্তারিত জানালে ওই নার্সের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় ভারতীয় হাইকমিশন কার্যালয়ে। বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন গত ২২ অক্টোবর শাহজাহানকে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে পাঠাবার উদ্যোগ নেন। অবশেষে সকল আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ১৮ নভেম্বর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

দেশে ফিরে শাহজাহান তার চার মামাকে আসামি করে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। আদালত মামলা তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন পিবিআইকে। যদিও পরবর্তীতে মামলা তুলে নেয়ার জন্য শাহাজাহানকে হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে জানায় সে।

এদিকে মামাদের এমন পৈশাচিক নারকীয়তায় ক্ষিপ্ত শাহাজাহানের বাবা ও স্বজনরা। এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায় শাহাজাহান এবং তার স্বজনরা।

এদিকে ২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি ওরসে যাওয়ার পর অনেক খুঁজাখুঁজি করেও শাহাজাহানকে না পাওয়ায় তার বাবা অনেকটা আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। হঠাৎ করে তাকে ফিরে পাওয়ার আশায় ব্যাকুল হয়ে অধীর অপেক্ষায় ছিলেন। অবশেষে হাত-কান ছাড়া ক্ষতবিক্ষত বিধ্বস্ত ছেলে তার এসেছে ফিরে। এজন্য তিনি প্রশাসনসহ সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

অনুসন্ধান, মামলার এজাহার সূত্র ও সরেজমিনে শাহাজানের ফুফুর বাড়িতে গেলে জানা যায়, টিলাগাঁও ইউনিয়নের ডরিতাজপুর গ্রামের বাসিন্দা মানিক মিয়ার সাথে তার স্ত্রীর পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। বিরোধের কারণে মানিক মিয়ার স্ত্রী স্বামীর সাথে খারাপ আচরণ করতে থাকেন। তখন মানিক মিয়ার ছেলে শাহাজান মিয়া তার বাবার পক্ষ নিয়ে তার মাকে বুঝানোর চেষ্টা করে। সেই কারণে শাহাজানের মামা ওয়াছির মিয়া, ফুরকান মিয়া, মবশ্বির মিয়া ও ইয়াছিন মিয়া তার ওপর তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। তখন থেকেই শাহাজানের মামারা তাকে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে হত্যা করে লাশ গুম করার হুমকি দেয়। এরপরও শাহাজান তার বাবার পক্ষ নিয়ে কথা বললে মামারা তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে।

ভুক্তভোগী শাহাজান অভিযোগ করে বলেন, পারিবারিক অনেক বিষয় নিয়ে আমার বাবা ও মায়ের প্রায়শই ঝগড়া হতো। আমি বাবার পক্ষ নিয়ে কথা বলায় আমার মামারা আমার ওপর রাগান্বিত হন। সেই আক্রোশের জেরে মামা ফুরকানের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ মুখোশধারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে আমাকে চাতলাপুর সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার সামনে মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে ফেলে রেখে যান। পরে বিএসএফ আমাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করে।

সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে জীবনের বিভীষিকাময় ঘটনা তুলে ধরেন বাংলাদেশ জার্নালের এই প্রতিবেদকের কাছে। জানান প্রাণে বেঁচে যাওয়া লোমহর্ষক ঘটনার কাহিনী। এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তার ও তার স্বজনদের। শাহাজানের মামারা প্রকাশ্য বাড়িতে থেকে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে বলেও জানায় সে।

শাহাজানের মামা ওয়াছির মিয়া তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, পরিবারের সবার অগোচরে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে কোথায় গেছে, সেটা আমরা জানি না। আমরা কেনো তাকে মারতে যাবো। তৃতীয় পক্ষ হয়তো কেউ আমাদের ফাঁসাতে এমন ষড়যন্ত্র করছে। প্রশাসন তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনার রহস্য উন্মোচন করবে।

শাহাজানের মামা ফুরকান আলীও অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, শাহজান পাগল অবস্থায় বাড়ি থেকে কোথায় গেছে, তা আমরা বলতে পারবো না।

শাহজানের হাত, কান ও মাথায় কে আঘাত করলো প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেউ না কেউ তো ঘটনাটি ঘটিয়েছে। আমরা এই বিষয়ে কিছুই জানি না।

শাহাজানের ফুফু রুপজান বিবি বলেন, শাহাজান খুবই শান্ত ও সহজ-সরল প্রকৃতির ছেলে। পরিবারে ৪ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। দেড় বছর আমরা তাকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেছি। পরে জানতে পারি সে ভারতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। সরকারের মাধ্যমে তাকে দেশে আনা হয়। এখন সে মামাদের ভয়ে আমার বাড়িতে রয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।

শাহাজানের মামাতো ভাই সমাজকর্মী ও ছাত্রলীগ নেতা এস এম লুৎফুর রহমান বলেন, অনেক খোঁজাখুঁজির পর যখন জানতে পারি সে ভারতে রয়েছে, তখন তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য গত ৬ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করি। এরপর দুই দেশের হাইকমিশনের মাধ্যমে গত ১৮ নভেম্বর শাহাজানকে দেশে আনা হয়। দেশে ফিরলেও তার মামারা বিভিন্ন হুমকি-ধামকি দিচ্ছে, আতঙ্কে রয়েছে সে। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেন হয় এমন দাবি জানাচ্ছি।

শাহাজানের বাবা মানিক মিয়া বলেন, ছেলে সুস্থ, সবলভাবে ওয়াজ মাহফিলে যাওয়ার কথা বলে তিন বছর আগে বাড়ি থেকে বের হয়। দেড় বছর পর স্থানীয় চেয়ারম্যানের মাধ্যমে জানতে পারি ছেলে ভারতে আছে। এখন সে সরকারের সহযোগিতায় দেশে ফিরেছে। আমার ছেলে ভয়ে বাড়িতে আসতে চায়নি, তাকে আমার বোনের বাড়িতে রেখেছি।

এ ব্যাপারে কুলাউড়া থানার অফিসার্স ইনর্চাজ বিনয় ভূষণ রায় বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, আমার কাছে আসলে বিজ্ঞ আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেই। আদালত থেকে নির্দেশনা আসলে আমরা প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার বাংলাদেশ জার্নালকে মো. আবু ইউসুফ বলেন, আমরা তদন্ত শুরু করেছি। তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ছেলেটাকে দেখতে যাবো। আমাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব রকমের সহায়তা দেয়া হবে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত