ঢাকা, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

জীবিকার উৎস্য যখন ধুলোবালি

  নুরুল আলম, মিরসরাই

প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৩:৪৮  
আপডেট :
 ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৩:৫৭

জীবিকার উৎস্য যখন ধুলোবালি
ছবি: প্রতিনিধি

শতশত মানুষের জীবিকার উৎস্য যখন ধুলোবালি ময়লা। চট্টগ্রামের মিরসরাই পৌরসভায় গড়ে উঠেছে এ ধুলোবালির-কারখানা। শতশত নারী শ্রমিক লাইন ধরে ধুলোবালি থেকে খুঁজে খুঁজে বের করছেন স্ক্যাপ লোহা, তামা, তার, প্লাস্টিকের টুকরো।

উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ১৫০ থেকে ২০০জন নারী শ্রমিক এখানে কাজ করেন। দিনদিন বাড়ছে শ্রমিকের সংখ্যাও। সারাদিন কাজ শেষে পারিশ্রমিক ৩০০ টাকা হাতে পেয়ে তারা খুশি মনে ফিরে যাচ্ছেন বাড়ি। এই ধুলোবালি-ময়লা এখন তাদের জীবন- জীবিকার উৎস।

বৃহস্পতিবার মিরসরাই পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের বাদামতলী ইসমাইল কার্পেট মিল সংলগ্ন সড়কের পাশে অবস্থিত কারখানায় সরোজমিনে গিয়ে খোঁজ নিতেই জানা যায়, ২০১৮ সালে স্থানীয় উদ্যোক্তা ফরহাদ হোসাইন এই ব্যবসাটি গড়ে তুলেছেন। চারিদিকে প্রাচীর দেয়া প্রায় ২ একর জায়গাতে গড়ে উঠেছে ধুলোবালি থেকে স্ক্যাপ বাছাই ব্যবসা। এখানে ধুলোবালি থেকে স্ক্যাপ বাছাই করছেন প্রায় ১৫০ জন মহিলা শ্রমিক। বাছাইয়ের পর ভাল ভাবে পরিস্কার করে বস্তাজাত করা হচ্ছে। এখান থেকে বাজার জাত করা হয় ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানিতে।

ফরহাদ হোসেন জানান, সীতাকুন্ড শিপ ইয়ার্ডে পুরাতন জাহাজ কেটে বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম) কোম্পানী ইস্পাত, লোহা তৈরির জন্য স্ক্যাপ গুলো বারইয়ারহাট বিএসআরএম কারখানায় নিয়ে কয়েক দপা বাচাই করেন। এখানে লোহা বাচাইয়ের পর অবশিষ্ট ডাস্টগুলো আমরা কিনে এনে আবার বাচাই করি। এসব ডাস্টের মধ্য ছোট ছোট লোহা,তামা, এ্যালমুনিয়াম, তার, প্লাস্টিক টুকরো থাকে। সেগুলো বাচাইয়ের পর আলাদা আলাদা ব্যাগে ভরে রাখা হয়। কারণ ভিন্ন ভিন্ন মালের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দাম। ভিন্ন ভিন্ন ক্রেতা।

চট্টগ্রাম- ভাটিয়ারী থেকে এসে বিভিন্ন দামে কিনে নেন ব্যবসায়ীরা। তারা সরবরাহ করেন ভিন্ন ভিন্ন কারখানায়। এগুলো গলিয়ে আবার নতুন কিছু তৈরি করা হয়। কিছু লোহার সাথে প্লাস্টিক লাগানো থাকে। সেগুলো পুড়ে গলিয়ে আলাদা করতে হয়। পরিবেশ দুষণের সম্ভাবনা থাকায় আমরা না পুড়ে একসাথে বিক্রি করে থাকি। ব্যবসায়িরা কিনে নেয়ার পর কারখানায় পুড়ে লোহা প্লাস্টিক আলাদা করে নেন।

ধুলোবালি থেকে স্ক্যাপ বাছাইয়ের সময় কথা হয় ৬৫ বছরের বৃদ্ধা জেবু ধন এর সাথে, দুই বছর ধরে এখানে কাজ করি। প্রতিদিন ৩০০টাকা কামাই করে নিজের আয় দিয়ে চলতে পারি। এটাই আমার জীবিকার উৎস। স্বামী নুর মোহাম্মদ মারা যাওয়ার পর ৫ ছেলে ২ মেয়ে আমাকে কেউ ভরণপোষণ দেয়না। সবাই যার যার পরিবার নিয়ে আলাদা থাকে। এক ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী। তাকে নিয়ে এখন আমার সংসার।

এক সাথে কাজ করেন নাজমা আক্তার। তিনি বলেন, দেড় বছর ধরে ধুলোবালি থেকে লোহা স্ক্যাপ বাছাই কাজ করে সেই বেতনে সংসার চালাই। এক ছেলে ৮ম শ্রেণিতে পড়ে। এই কাজ না করলে উপোস থাকা লাগতো।

ছালেহা বেগম (৬৫) তিনি জানান, তিন বছর ধরে এখানে কাজ করেন। একদিন কাজ না করলে সংসার চলেনা। সংসার খরচ বাঁচিয়ে বাকি টাকা দিয়ে প্রতি সপ্তাহে এনজিও-র কিস্তি চালাতে হয়।

আরেকজন শ্রমিক নাজমা আক্তার (৩৫) জানান, স্বামী মারা যাওয়ার পর অনেক উপোস ছিলাম। গত তিন বছর এখানে কাজ করে ভালো ভাবে চলছি। প্রতিদিন ৩০০টাকা বেতন। আমার ২ছেলের মধ্যে বড়ো ছেলে মিরসরাই মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ট শ্রেণিতে পড়ে, ছোট ছেলে ৪র্থ শ্রেণিতে। এরকম শতশত অসহায় নারীদের এখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। ধুলোবালি এখন তাদের জীবিকার উৎস।

সরকারের সহযোগিতা পেলে ব্যবসার প্রসার ঘটাতে চান তরুণ উদ্যেক্তা ফরহাদ হোসাইন। ফরহাদ হোসাইন জানান, বর্তমানে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০জন মহিলা শ্রমিক কাজ করছে। গড়ে অর্ধ লক্ষ টাকা বেতন দিতে হচ্ছে তাদের। এটা একদিকে পরিবেশ সুরক্ষা হচ্ছে। অন্যদিকে সৃষ্টি হয়েছে দুস্থ, বেকার, অভাব গ্রস্থ মানুষের কর্মসংস্থান। আর এ কাজ সম্পন্ন করতে শতভাগ নারী শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। কারণ যাদের মধ্যে বেশির ভাগ বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত, দুস্থ। এদের অন্য কোন আইয়ের উৎস নেই। এই ধুলোবালি তাদের জীবিকার উৎস।

তিনি বলেন, এই ব্যবসায় লাভ যাই হোক আমি বন্ধ করবোনা। কারণ গ্রামের নিরক্ষর, দরিদ্র, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত দুস্থ নারীদের জন্য সৃষ্টি হয়েছে এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ। এক সপ্তাহ বন্ধ রাখলে অনাহারে থাকে অভাবী পরিবার গুলো। তারা আমার ঘরে এসে কান্নাকাটি করে। অন্য কোন কাজে তাদের কেউ নেয়না। তাদের পরিবারের জীবন জীবিকা চলে এখানে কাজ করে।

তিনি ব্যবসার প্রসার ঘটাতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছেন। আর সহযোগিতা পেলে গড়ে তুলতে চান ডাস্টের পাশাপাশি ডাস্ট কাটিং কারখানা। যা থেকে আরও কয়েকশো পরিবারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে বলে তিনি আশা করছেন।

ফরহাদ হোসাইন মিরসরাই পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের মৃত আজিজুল হকের ছেলে।

বাংলাদেশ জার্নাল/ওএফ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত