ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

এক কাতারে ধনী-গরিবের ইফতার

  মনির ফয়সাল, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৩, ১১:২৯  
আপডেট :
 ২৫ মার্চ ২০২৩, ১২:৩৬

এক কাতারে ধনী-গরিবের ইফতার
ছবি: প্রতিনিধি

ছানিয়ে কাবা হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামে মোগল বিজয়ের স্মারক আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। জুমা মসজিদ হিসেবেই সবার কাছে বেশি পরিচিত। চট্টগ্রামের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আগ্রহে ধারাবাহিকভাবে এই ঐতিহাসিক মসজিদের খতিবের দায়িত্ব পালন করে আসছেন রাসূল (সা:)-এর আওলাদগণ। ১৯৯৬ সাল থেকে এ মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন আওলাদে রাসূল (সা:) মাওলানা ছাইয়্যেদ মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন তাহের জাবেরী আল মাদানী। ঐতিহ্যবাহী জুমা মসজিদের খতিবের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০০১ সাল থেকে এখানে আয়োজন করা হচ্ছে ধনী-গরিবের বৈষম্যহীন সুবিশাল ইফতার আয়োজন।

মসজিদের খোলা বারান্দায় একাধিক সারিতে রমজানের প্রথমদিন থেকে কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিদিন অন্তত দেড় থেকে দুই হাজার মানুষের একসঙ্গে ইফতার আয়োজনের ব্যবস্থা রয়েছে এ মসজিদে। তবে রোযা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিন-চার হাজার রোজাদার একসঙ্গে ইফতারে অংশ গ্রহণ করেন।

জানা যায়, সেহরির পরপরই শুরু হয় ইফতার তৈরির আয়োজন। বাবুর্চিরা কাজে নেমে পড়েন মসলাপাতি ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে। প্রস্তুত করা হয় আনুষঙ্গিক অন্যান্য জিনিসও। সকাল হলেই চুলায় দেয়া হয় আগুন। ছোলা, পিঁয়াজু, জিলাপি, বেগুনি, শরবতসহ বেশ কয়েকটি আইটেম বানানোর এ কাজ চলে বিকেল চারটা পর্যন্ত। এরপর থালা-বাসনে করে সে ইফতার পরিবেশন করা হয় রোজদারদের মাঝে।

প্রতিবছর রমজানে প্রতিদিন চার হাজার রোজাদারের এমন আয়োজন থাকে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে। আর এ ইফতারে শরিক হতে দূর-দূরান্ত থেকেও ছুটে আসেন অনেক রোজাদার।

সরেজমিনে দেখা যায়, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে শুরু করে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, সমাজের অনেক প্রতিষ্ঠিত মানুষের পাশেই ভিক্ষুক, রিকশাওয়ালা, হকারসহ নানা বয়সীরা শরীক হয়েছেন এ ব্যতিক্রমী ইফতার আয়োজনে। মসজিদের বারান্দায় সারি করে বসে আছেন তারা। হাজার হাজার মানুষ একসঙ্গে সমবেত হয়েছেন ইফতার করতে। কোনো ভেদাভেদ নেই, নেই কোনো উঁচু নিচু। সবাই সমান হয়ে গেছেন ইফতারের মজলিসে। বসে আছেন মসজিদের মেঝেতে।

মসজিদের মিম্বার থেকে ইসলামী মাসয়ালা-মাসায়েল বর্ণনা করা হচ্ছে। মেঝেতে বসে তা শুনছেন ধর্মপ্রাণ রোজাদাররা। ইফতারের আগে মোনাজাত হয়। কিছু সময় পর মাইকে সাইরেন বেজে ওঠে। একসঙ্গে ইফতার করেন প্রায় দেড় হাজার রোজাদার।

ইফতারসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ছোলা, মুড়ি, খেঁজুর, শরবত, জিলাপি, আলুর চপ, ছমুছা, অন্থন, পেঁয়াজু ইত্যাদি। ইফতার বণ্টন করেন মসজিদের কয়েকজন কর্মচারী ও সেচ্ছাসেবীরা।

শাহী জামে মসজিদের খতিবের সহকারী হাছান মুরাদ বলেন, এই মসজিদ তৈরির পর থেকেই রোজায় ইফতারের আয়োজন চলছে এখানে। তবে বড় পরিসরে গণ–ইফতারের আয়োজন করা হচ্ছে ২০০১ সাল থেকে। খতিব হুজুরের তত্ত্বাবধানে ইফতারের আয়োজন করা হয়। প্রথম কয়েকদিন দেড় থেকে দুই হাজার এবং এরপর থেকে চার হাজার রোজাদারের জন্য ইফতারের আয়োজন করা হয়। সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তৈরি করা হয় ইফতারি। টাটকা ও স্বাস্থ্যসম্মত ইফতারি যাতে সবাই খেতে পারেন সেই চেষ্টা করা হয়।

তিনি বলেন, অনেকে ইফতারের আয়োজনে সহযোগিতা করেন। এখানে যারা সহযোগিতা করেন তারা কেউ নামের জন্য করেন না। সবাই সওয়াবের উদ্দেশে ইফতার আয়োজনে শরিক হন।

উল্লেখ্য, আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের সঙ্গে মুঘলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের ইতিহাস সুনিবিড়ভাবে জড়িত। কথিত আছে, কিল্লাটি মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা ছিল। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামের তৎকালীন মোগল শাসনকর্তা শায়েস্তা খাঁর ছেলে উমেদ খাঁ এ কেল্লার ভেতরে প্রবেশ করলে তখন থেকে এর নাম হয় ‘আন্দরকিল্লা’।

মসজিদের ইতিহাস পরবর্তীতে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে (আরবি ১০৭৮ হিজরি) মোগলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে জলদস্যুদের আস্তানায় মসজিদ নির্মাণ করেন। এ মসজিদের নামকরণ করেন ‘আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ’।

৫৬ বছর পর চট্টগ্রামের আরেক শাসনকর্তা নবাব ইয়াসিন খাঁ ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের সন্নিকটে পাহাড়ের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের একটি টিলার ওপর আরেকটি পাকা মসজিদ নির্মাণ করেন। যার নাম রাখেন ‘কদম রসুল’। একসময় আন্দরকিল্লা মসজিদের চেয়ে কদম রসুল মসজিদটি গুরুত্ব পেতে থাকে আর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদটি মুসল্লি ও গুরুত্ব হারাতে থাকে। এক পর্যায়ে আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদটি লোকশূন্য হয়ে পড়ে। এ সুযোগে ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদটিকে তাদের গোলাবারুদ রাখার গুদাম হিসেবে ব্যবহার শুরু করে।

পরবর্তীতে ১১৫ বছর পর হামিদুল্লাহ খাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের নামাজের জন্য আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদটি আবারও উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ১৬৬৭ সাল থেকে এ মসজিদ ঘিরে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপক আনাগোনা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আওলাদে রাসুলগণই এ মসজিদের ইমাম নিযুক্ত হতেন। যার ধারাবাহিকতা এখনও বিদ্যমান। বর্তমানে এ মসজিদের খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন আওলাদে রাসূল (সা:) মাওলানা ছাইয়্যেদ মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন তাহের জাবেরী আল মাদানী।

আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদ চট্টগ্রামসহ তার আশপাশের মানুষের আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসার মসজিদে রূপ নেয়। বিশেষ করে জুমআর নামাজ পড়তে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে মুসল্লিরা উপস্থিত হন। আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের স্থাপত্য ও গঠন মোগল রীতি অনুযায়ী তৈরি। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট উপরে ছোট্ট পাহাড়ের ওপর মসজিদটির অবস্থান।

চট্টগ্রামে মুসলিম বিজয়ের স্মারকস্বরূপ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদটি। এ মসজিদের মূল ভবনের প্রবেশপথে কালো পাথরের খোদাই করে সাদা অক্ষরে ফার্সি ভাষায় যা লেখা রয়েছে, তা বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়- 'হে জ্ঞানী! তুমি জগৎবাসীকে বলে দাও, আজ এ দুনিয়ায় ২য় কাবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।' যার প্রতিষ্ঠাকাল ১০৭৮ হিজরি। এখানেই খোদাই করা রয়েছে তার প্রতিষ্ঠার নামও।

বাংলাদেশ জার্নাল/ওএফ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত