ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

পাহাড়ে ভয়ংকর কেএনএফ, পর্যটন শিল্পে ধসের আশঙ্কা

  বান্দরবান প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৩, ১৯:৩৮  
আপডেট :
 ২৫ মার্চ ২০২৩, ১৯:৫১

পাহাড়ে ভয়ংকর কেএনএফ, পর্যটন শিল্পে ধসের আশঙ্কা
পাহাড়ে ভয়ংকর কেএনএফ। সংগৃহীত ছবি

তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে বান্দরবান সবচেয়ে শান্তি ও সম্প্রীতির জেলা হিসেবে পরিচিত থাকলেও গত বছর থেকে কেএনএফের সশস্ত্র কর্মকাণ্ড, জঙ্গিদের দৌরাত্ম্য, হত্যা, গোলাগুলি, অপহরণের ঘটনায় শান্তিচুক্তির আগের অবস্থায় ফিরছে না তো পাহাড়? এমন প্রশ্ন এখন স্থানীয়দের মুখে মুখে।

সূত্রে জানা যায়, ‘কুকি-চিন রাজ্য’ নামে একটি পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনরত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) মনে করে, পাহাড়ের ৯টি উপজেলা তাদের পূর্বপুরুষদের আদিম নিবাস, দখলদাররা অনুপ্রবেশ করে তাদের ভূমি দখল করে নেয়। জেএসএসসহ অন্য সংগঠনগুলো তাদের ভূমি ব্যবহার করে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করে বিভিন্ন অপরাধ করছে, তাই এসব থেকে মুক্তি পেতে এই সংগঠনের সৃষ্টি। সংগঠনটি ২০১৭ সালে কেএনভি নামে সশস্ত্র সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে শতাধিক সক্রিয় সদস্য কাচিন, কারেন প্রদেশ এবং মণিপুর রাজ্যে প্রশিক্ষণে পাঠায়। ২০১৯ সালে কমান্ডো প্রশিক্ষণ শেষে তারা সশস্ত্র অবস্থায় ফিরে আসে। দেশের রুমা সীমান্ত ও ভারতের মিজোরাম সীমান্তের জাম্পুই পাহাড়ে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত এ সংগঠনের সশস্ত্র ও নিরস্ত্র মিলিয়ে মোট ৬০০-র বেশি সদস্য আছে। বর্তমানে তারা বান্দরবান ও রাঙামাটির অন্তত পাঁচটি উপজেলায় ঘাঁটি গেড়ে এসবিবিএল, একে ৪৭, এসএমজি, পিস্তল, নিজস্ব পদ্ধতিতে তৈরি ল্যান্ডমাইন ব্যবহার করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত।

বান্দরবানের সীমান্ত এলাকায় জঙ্গি সংগঠন ও কেএনএফের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর যৌথ অভিযানের কারণে গত ১৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া পর্যটক যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞায় জেলার দুই শতাধিক হোটেল-মোটেল কার্যত পথে বসার অপেক্ষায়। অনেকে তাদের কর্মচারী ছাঁটাই করেছে। অন্যদিকে জেলার থানচি ও রুমার দুই শতাধিক নৌযান, জেলার পর্যটক বহনকারী তিন শতাধিক চাঁদের গাড়ি ও ৩০০ জন ট্যুরিস্ট গাইড এখন বেকার সময় কাটাচ্ছেন। জুম চাষাবাদ করতে না পারার কারণে পাহাড়িরা নিজেদের খাদ্য সংগ্রহ করতে পারছেন না, ফলে অর্থনৈতিকভাবে চরম সংকট পার করছেন ব্যবসায়ীরা।

জেলার তিন উপজেলায় অপহরণ, গুলিবর্ষণ, হত্যা ও বন্দি করার কারণে সরকারের সড়ক নির্মাণ, ব্রিজ, কালভার্ট ও স্কুল ভবন নির্মাণে কাজ করা শ্রমিকরা তিন উপজেলা ছাড়ছেন। যেকোনো সময় অপহরণের শিকার হতে পারেন- এমন ভাবনায় তারা জেলা সদরে ফিরছেন। ফলে স্থবিরতা বিরাজ করছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে।

যৌথ অভিযানের সময় দুই কেএনএফ সদস্য ও কেএনএফের গুলিতে মগ পার্টির তিনজন নিহত হন। ১১ মার্চ থানচি থেকে কেএনএফ ১২ জন নির্মাণশ্রমিককে অপহরণ করে। এদের মধ্যে একজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হন এবং চারজনকে জিম্মি করে রাখে। ১২ মার্চ দুপুরে কেএনএফের গুলিতে সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন মারা যান এবং দুই সেনাসদস্য আহত হন। ১৫ মার্চ রুমার লংথাসি ঝিরি এলাকায় সড়কে কাজ করতে গিয়ে কেএনএফ সদস্যরা অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট আনোয়ারসহ ৯ জনকে ধরে নিয়ে যায়। গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বম সম্প্রদায়ের ৩০ জনকে যৌথ বাহিনী আটক করেছে জানিয়ে গত ১৮ মার্চ এক বার্তায় কেএনএফ তাদের মুক্তির দাবি জানায়, তা না হলে আনোয়ার হোসেনকে হত্যা করা হবে বলে উল্লেখ করে।

অন্যদিকে যৌথ বাহিনী জানায়, এ সময়ে পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ৬৮ জন জঙ্গি ও কেএনএফের বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়। গত বছরের ১৫ নভেম্বরের পর ১৩২টি পরিবারের ৫৪৮ জন মানুষ মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছেন। ১০ মার্চ রাঙামাটির বিলাইছড়ির ৪ নম্বর বড়থলি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের তিনটি পাড়া থেকে ৫৬ পরিবারের ২২০ জন তংচঙ্গ্যা রেইছা ও রোয়াংছড়ি সদরে আশ্রয় নেন।

সূত্রে জানা যায়, কেএনএফের সহায়তায় বম সম্প্রদায়ের অনেকে মিজোরামে আশ্রয় নিলেও তাদের অনেকে চেন্নাই ও ব্যাঙ্গালুরুর বিভিন্ন হোটেলে কাজ করতে পাড়ি জমান। তারা সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ না নেয়ায় তাদের ওপর কেএনএফ ক্ষুব্ধ হয়। এসব বিষয়ে তাদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় কেএনএফের প্রধান নাথান বম ও সংগঠনটির চিফ অব স্টাফ পানতালা হেডম্যান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ভানচুন লিয়ান মাস্টারের উপস্থিতিতে মিজোরামের লংতালাই জেলার হুমুনুয়াম গ্রামে এই দ্বন্দ্ব নিরসনে গত ১০ মার্চ বৈঠক ডাকে। এই বৈঠক থেকে আসাম রাইফেলস কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেসিএনএ) দুই ক্যাডার রুমার রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নের সালৗপি পাড়ার নাথান বমের সহকারী জিংরামলিয়ান বম (৩২) ও রোয়াংছড়ির অবিচলিত পাড়ার (গিলগার) পাড়ার কেএনএফ কমান্ডো পাজাউ বমকে (২২) গ্রেপ্তার করে। আসাম রাইফেলস দাবি করে, তারা মিয়ানমারে অস্ত্র পাচার করছে। এ সময় নাথান ও শিক্ষক ভানচুন লিয়ান মাস্টার পালিয়ে যান।

জেলা শহর থেকে রোয়াংছড়িতে রঙের কাজ করতে যাওয়া ঠিকাদার আশিষ দেবনাথ বলেন, ‘পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার কারণে, জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমরা কাজ ফেলে শ্রমিকদের নিয়ে জেলা সদরে চলে এসেছি।’

বান্দরবান, হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির অর্থ সম্পাদক রাজিব বড়ুয়া বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতির কারণে আমাদের পর্যটন ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে, তা বলে বোঝাতে পারব না, আর এসব থেকে পরিত্রাণ আশা করি।’

বান্দরবান জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি মো. মুসা বলেন, ‘আগে কখনো কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গাড়িচালকদের আক্রমণ করত না, এখন যেভাবে আক্রমণ ও অপহরণ হচ্ছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন।’

এ ব্যাপারে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা বলেন, এলাকার সব সম্প্রদায়ের শান্তির জন্য তাদের সব অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীকে অস্ত্র সমর্পণ করা উচিত, তাহলে এই এলাকায় শান্তি বিরাজ করবে।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন করলে বান্দরবানে ফের শান্তি ফিরবে, বাঙালিসহ ১১টি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি বজায় থাকবে বলে আশা স্থানীয়দের।

বাংলাদেশ জার্নাল/কেএ/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত