ঢাকা, সোমবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩০ আপডেট : ১১ মিনিট আগে
শিরোনাম

‘কমিউনিটি ক্লিনিক হামার ভরসা’

  আলমগীর ইসলাম, উত্তরাঞ্চল

প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২১:০৬  
আপডেট :
 ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২১:২২

‘কমিউনিটি ক্লিনিক হামার ভরসা’
অবহেলিত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে সারাদেশে এখন ১৪ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। ছবি: প্রতিবেদক

‘শহরের হাসপাতাল যেয়া চিকিৎসা করির পাইনা। হামরাগুলা গরীব মানুষ, অভাবের সংসার। বাড়ির পাশে কমিউনিটি ক্লিনিক হামার ভরসা। সমস্যার কথা কইলে ডাক্তার আপা ঔষধ-বড়ি দেয়। টাকাও নেয় না। দিন বদলিছে, দেশও ডিজিটাল হইচে। ডাক্তারেরা বাড়ি বাড়ি আসি খোঁজ খবর নেয়।’ কথাগুলো বলছিলেন- রংপুর জেলার তারাগঞ্জ উপজেলার কিসামত মেনানগর কুঠিয়াল পাড়া গ্রামের মোছা. ফজিলা বেওয়া (৬৪)।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বাংলাদেশের সব মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালে কমিনিটি ক্লিনিক ভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু করেছিলেন, যা সারা দেশের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের দোরগোড়ায় সরকারের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সুফল সরবরাহে বিপ্লব ঘটিয়েছে। অন্তত মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য, সাধারণ অসুখ-বিসুখে প্রাথমিক সেবাটুকু পাওয়া যায় কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে।

অবহেলিত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে সারাদেশে এখন ১৪ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এরমধ্যে উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে ৩ হাজার ৮৯১টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে সরকার। রাজশাহী বিভাগে মোট ক্লিনিকের সংখ্যা ১৯৯৮টি, নতুন করে বেড়েছে ২টি। রাজশাহী জেলায় ২৩৫টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৫১টি, নওগাঁয় ৩০৪টি, নাটোরে ২০২টি, জয়পুরহাটে ১১৩টি, বগুড়ায় ৩৭০টি, সিরাজগঞ্জে ৩৬৫টি ও পাবনায় ২৫৮টি। এছাড়াও রংপুর বিভাগে মোট ক্লিনিকের সংখ্যা ১৮৯১টি। জেলা পর্যায়ে রংপুরে ৩১১টি, গাইবান্ধায় ৩২০টি, কুড়িগ্রামে ২৯৩টি, লালমনিরহাটে ১৮০টি, নীলফামারীতে ১৯৬টি, দিনাজপুরে ৩৩৩টি, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৪৮টি ও পঞ্চগড়ে ১১০টি ক্লিনিকের মাধ্যমে একযোগে স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এসব কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামের অবহেলিত, গরিব, অসহায় ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষজন সহজেই প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, গত রোববার তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের মাটিয়াল পাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে স্বাস্থ্য সেবা নিতে আসেন জরিনা বেগম (২৬), ফরিদা আক্তার (২০), হাসনা বানু (৩৮), লিপি বেগমসহ প্রায় অর্ধশত নারী ও শিশু। সেবা গ্রহীতারা লাইনে দাঁড়িয়ে কোনরকম ভোগান্তি ছাড়াই সেবা নিচ্ছেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে প্রায় প্রতিদিনেই এমন দৃশ্য চোখে পড়ে।

উন্নত স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের লক্ষ্যে উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে অবস্থিত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে একজন করে মেডিকেল অফিসার (এমবিবিএস ডাক্তার) নিয়োগ দিয়েছে। এটি সমন্বিত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সংক্রান্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় আলোকবর্তিকা। সম্প্রতি দেশের স্বাস্থ্য খাতে অন্যতম আলোচিত বিষয় ‘রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথকেয়ার ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্প বা কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প।

উত্তরাঞ্চলে অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসাসেবা প্রদানের প্রথম স্তর কমিউনিটি ক্লিনিক। তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের চাহিদা অনুসারে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার হিসেবে কাজ করছে। এখানে কর্মরত কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডার, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারীরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে।

ক্লিনিকে আগত সেবা গ্রহণকারীদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, স্যানিটেশন, সুষম খাদ্যাভ্যাস, টিকার সাহায্যে রোগ প্রতিরোধ, গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা বিষয়ক পরামর্শ দেয়া, কৃমি প্রতিরোধ, বুকের দুধের সুফল, ডায়রিয়া প্রতিরোধ এবং পুষ্টি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।

কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে বিনা মূল্যে প্রায় ৩২ ধরনের ওষুধ দিয়ে থাকে। এসবের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা এবং পুষ্টি সংক্রান্ত পরামর্শ দেয়া হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সার্বিক প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যার আওতায় অন্তঃসত্ত্বা নারীদের প্রসবপূর্ব (প্রতিরোধ টিকাদানসহ), প্রসবকালীন এবং প্রসবোত্তর সেবা। এছাড়া সাধারণ জখম, জ্বর, ব্যথা, কাটা, পোড়া, দংশন, বিষক্রিয়া, হাঁপানি, চর্মরোগ, কৃমি এবং চোখ, দাঁত ও কানের সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা হয়। সময়মতো প্রতিষেধক টিকা; যেমন- যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কফ, পোলিও, ধনুষ্টঙ্কার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়া ইত্যাদিসহ কমিউনিটি ক্লিনিকে শিশু ও কিশোর-কিশোরিদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবাও দেয়া হয়। উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরবর্তী সময়ে সিরাজগঞ্জ, রংপুর, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলায় বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ফলে সেসব এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী কর্মীরা দ্রুত চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে।

বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বুড়িগঞ্জ ইউনিয়নের খাদইল ফকির পাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে জ্বর, মাথা ব্যথা ও সর্দি নিয়ে আসেন মোছা. আনজিরন বেগম (৩৪)। দ্রুত সময়ে সঠিক চিকিৎসা ও ওষুধ পেয়ে বেশ খুশি তিনি। গ্রাম থেকে জেলা হাসপাতাল বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দূরত্ব বেশি। ফলে এই ক্লিনিকেই নিয়মিত সেবা নিতে আসেন সুবিধাভোগী নারী। তিনি বলেন, ‘হামাগের জন্যে সরকার অনেক সুবিধা করি দ্যাওচে, ফ্রিতে ঔষধ পাওয়া যায়।’

রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. এ.বি.এম আবু হানিফ বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘বন্যা কবলিত এলাকাগুলোকে আগে থেকেই সতর্ক করা হয়। তবে বন্যার আগেই কমিউনিটি ক্লিনিক সেবা প্রদানকারীরা লজিস্টিক সাপোর্টসহ ওষুধপত্র সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়। পরে ঐসব এলাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা পরিবার পরিকল্পনার সমন্বয়ে দ্রুত সেবা দেয়া হয়। আগে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে তিনটি করে কক্ষ ছিল। এখন এটিকে পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় তলা মডেল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে করে সেবার পরিধি আরও উন্নত হবে।’

রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. আনোয়ারুল কবির বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘কি করে ভালো সেবা নিশ্চিত করা যায় এজন্য কাজ চলছে। উপজেলা পর্যায়ে যে স্বাস্থ্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে তারাও সহযোগিতা করছে। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সেবায় যাতে কোন অসুবিধা না হয় এজন্য উচ্চ পর্যায় থেকে সব সময় মনিটরিং রয়েছে। সঠিক সেবা প্রদানের জন্য সেবা প্রভাইডারদের উন্নত প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। নিয়মিত প্রতিবেদন নেয়া হয়, পরে সেই প্রতিবেদনগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রেরণ করা হয়।’

বাংলাদেশ জার্নাল/এমপি

  • সর্বশেষ
  • পঠিত