ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

নিয়োগ পদ্ধতির প্যাঁচে বেকারদের গচ্চা শত কোটি টাকা

  আসিফ কাজল

প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২১, ১২:০৭  
আপডেট :
 ১৩ অক্টোবর ২০২১, ১২:৩৯

নিয়োগ পদ্ধতির প্যাঁচে বেকারদের গচ্চা শত কোটি টাকা

জটিল পদ্ধতির কারণে শিক্ষিত বেকারের জন্য ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) এই ফাঁদে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। এরপরও মিলছে না বহুল কাঙ্খিত নিয়োগ। গত আড়াই বছরে প্রতিষ্ঠানটি একজনও নিয়োগ দিতে না পারলেও এ সময়ে বেকারদের কাছ থেকে আদায় করেছে ২০০ কোটি টাকার বেশি।

শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের অপেক্ষায় থাকা ব্যক্তিরা বলছেন, দফায় দফায় আবেদন ফি আদায় করে এনটিআরসিএ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এতে দেশের নিম্নবিত্ত পরিবারের উচ্চ শিক্ষিত তরুণরা ঋণগ্রস্থ হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। একইসঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি স্বীকারও করেছেন এনটিআরসিএ এর একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলেছেন, শিক্ষক নিয়োগে এখনো আইন তৈরি না হওয়ায় এই জটিলতা নিরসন করা যাচ্ছে না।

বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে প্রার্থীদের সনদ দিতে ২০০৫ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে এনটিআরসিএ। এই সনদ নিয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য স্কুল কলেজে আবেদন করতেন প্রার্থীরা। এরপর ব্যবস্থাপনা কমিটি পরীক্ষা নিয়ে তাদের নিয়োগ দিতো। এই জটিলতা নিরসনে ২০১৫ সাল থেকে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতায় পরিবর্তন করে এনটিআরসিএকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে শুরু থেকে প্রতিষ্ঠানটি নানা জটিলতা ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। দফায় দফায় মামলায় জড়িয়ে স্থবির হয়ে যায় এর কার্যক্রম। ফলে যে সুশাসন, যোগ্যতা, দক্ষতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে শিক্ষক নিয়োগের যে কথা বলা হয়েছিল তা অধরাই রয়ে গেছে।

জটিলতার ধাপে ধাপে ভোগান্তি

এনটিআরসিএ এর নিয়ম অনুযায়ী, সারা দেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্যপদের বিপরীতে এন্ট্রি পর্যায়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে প্রার্থীদের প্রিলিমিনারি, লিখিত, মৌখিক ও জাতীয় সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান পেতে হয়। এরপর নিয়োগের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি বা সার্কুলারের মাধ্যমে প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদন নেয়া হয়। চূড়ান্ত ধাপে মেধা তালিকার শীর্ষ সারি থেকে শূন্যপদে একজন শিক্ষককে সুপারিশ করা হয়। তবে তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে পুলিশ ভেরিফিকেশন শুরু হওয়ায় ভোগান্তি চরম মাত্রায় ঠেকেছে বলে অভিযোগ করছেন চাকরিপ্রার্থীরা।

জানা যায়, ২০১৫ সালে ক্ষমতা পাওয়ার পর পূর্বের সনদধারীরা চাকরি পাওয়ার সুযোগ চেয়ে আন্দোলন শুরু করে। এরপর হাইকোর্টে তারা একটি রিট করে। হাইকোর্টের আদেশে ১৫তম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিয়ে একটি জাতীয় সমন্বিত মেধা তালিকা করা হয়। এই তালিকা ধরে ২০১৮ সালে দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৪০ হাজার পদে নিয়োগ দেয় এনটিআরসিএ। এই নিয়োগের পরও একাধিক মামলা হয়। এসময় ১৩তম পরীক্ষার প্রার্থীরা আরেকটি রিট করে আলাদা নিয়োগ দাবি করে। ২০২০ সালের মার্চে দেয়া এক রায়ে আপিল বিভাগ ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ২ হাজার ২০৭ জনকে নিয়োগ সুপারিশের নির্দেশনা দেন।

২০১৫ সালের আগে যারা এনটিআরসিএ এর সনদ পেয়েছেন তারা মেধা তালিকায় একদম পিছিয়ে। ফলে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে তারা শত শত বিদ্যালয়ের শূণ্য পদে আবেদন করেও চাকরির সুপারিশ পাননি। কিন্তু প্রত্যেকে প্রায় লাখ টাকার কাছাকাছি ব্যয় করেছেন। আবার এসব প্রার্থীর আবেদনের বয়স সীমাও নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে তারা সরকারি চাকরিতে অবসরকালীন সময় পর্যন্ত আবেদন করতে পারবেন।

এ বিষয়ে এনটিআরসিএ এর সচিব ওবায়দুর রহমান বলেন, এনটিআরসিএ এর এই নিয়োগ ব্যবস্থা খুবই জটিল। যা সমাধানের জন্য নতুন আইন তৈরি করে শিক্ষামন্ত্রণালয়েয় পাঠিয়েছে এনটিআরসিএ।

একাধিক আবেদনের বিষয়ে তিনি বলেন, ১৫তম পরীক্ষার আগে যারা সনদ নিয়েছেন তারা শুধু পাস করার জন্য পরীক্ষায় বসেছিলেন কারণ সে সময় ব্যবস্থাপনা কমিটি নিয়োগ দিতো। এখন যারা পরীক্ষায় বসছে তারা ভালো করছে। ফলে এই পিছিয়ে থাকা প্রার্থীরা নতুনদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। তারা বার বার আবেদন করেও চাকরি পাচ্ছে না।

যতোখুশি ততো আবেদনের ফাঁদ

এনটিআরসিএ শিক্ষক হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার জন্য প্রথম ধাপে পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সেখানে স্কুল বা কলেজ ক্যাটগিরিতে প্রার্থীরা আবেদন করেন। একটি আবেদনের খরচ ৩৫০ টাকা। আবার শিক্ষক হিসেবে চূড়ান্ত উত্তীর্ণ হওয়ার পর, অর্থাৎ জাতীয় মেধা তালিকায় স্থান করে নেয়ার পর আবার নিয়োগের জন্য নতুন করে আবেদন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি শূন্যপদের বিপরীতে আবেদন ফি ১০০ টাকা। অর্থাৎ, বাংলাদেশে একমাত্র চাকরি এই বেসরকারি শিক্ষক যেখানে দুবার আবেদনে টাকা নেয় সরকার।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এই গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের ক্ষেত্রেও আছে বড় সমস্যা। একজন চাকরিপ্রার্থী তার বিষয়ে সারা দেশে যতগুলো শূন্যপদ থাকবে, সবগুলোতে আবেদন করতে পারবেন। এক্ষেত্রে দেখা যায়, মেধা তালিকায় পিছিয়ে থাকা প্রার্থীদের কেউ কেউ ৫০০ থেকে ১ হাজার পর্যন্ত বিদ্যালয়ে আবেদন করেন। এতে তাদের ব্যয় হয় ১ থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। যাদের মেধা তালিকা উপরের দিকে তারাও ৫০ থেকে ৩০০টি শূণ্য পদে আবেদন করেন। কারণ তারা কেউই নিশ্চিত নন মেধা তালিকায় সবার উপরে কার নম্বর। এতে তারাও আবেদন ফি বাবদ ৫০-৬০ হাজার টাকা করে দেন এনটিআরসিএকে। নাম প্রকাশে এক নিয়োগ প্রত্যাশী বলেন, নিয়োগ ব্যবস্থাটা এমন করে রাখা হয়েছে যেনো যোগ্যতা থাকার পরও চাকরির জন্য জুয়া খেলতে হচ্ছে।

এনটিআরসিএ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি গত ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তির নিয়োগ সম্পন্ন করার পর দীর্ঘ এই আড়াই বছরে আর কোনো নিয়োগ দিতে পারেনি। ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধন আবেদনকারী ছিলেন ৮ লাখ ৭৬ হাজার। ৩৫০ টাকা ফি বাবদ আদায় হয়েছে ৩১ কোটি টাকা। ১৬তম আবেদনকারী ছিলেন ১১ লাখ ৭৬ হাজার, আবেদন ফি বাবদ আদায় ৪১ কোটি টাকা। ১৭তম নিবন্ধন পরীক্ষায় আবেদনকারী ছিলেন ১১ লাখ ৬৫ হাজার, আদায় হয়েছে ৪১ কোটি এবং তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য আবেদন পড়েছে ৯০ লাখ। ১১০ টাকা ফি বাবদ প্রায় ৯০ কোটি টাকারও বেশি। এভাবে গত আড়াই বছরে প্রতিষ্ঠানটি বেকারদের কাছ থেকে আদায় করেছে ২০৩ কোটি টাকা। অথচ এই টাকা জোগাড় করতে নিয়োগ প্রত্যাশীদের আত্মীয় স্বজনের কাছে হাত পাততে হয়। কেউ কেউ সুদের ওপর ঋণ নিয়ে আবেদন করেন। দেখা যায় চাকরি না হলেও ঋণের কিস্তি ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। এনটিআরসিএ এর সচিব ওবায়দুর রহমান বলেন, মূলত সমন্বিত মেধা তালিকায় পিছিয়ে থাকা প্রার্থীদের জন্য এ সমস্যা হয়েছে। তবে এটি তাদের জন্য সুযোগও বটে।

দেখা যায়, মেধা তালিকায় এগিয়ে থাকারা শূণ্য পদ পূরণ করলে তাদের জন্য যেসব খালি থাকে সেখানে যেতে পারে। তবে আমরা এই জটিলতা নিরসনের জন্য একটি আইন করছি। এটি হলে পিএসসির আদলে শুধু শূণ্য পদের বিপরীতে প্রার্থী চেয়ে পরীক্ষা নেয়া হবে। তখন এ সমস্যার থাকবে না।

বদলি না থাকায় শিক্ষক স্বল্পতা কাটছে না

বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি না থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক স্বল্পতা কাটছে না। সর্বশেষ তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, সুপারিশ পাওয়া ৩৮ হাজার শিক্ষকের মধ্যে প্রায় ২০ হাজারই ইনডেক্সধারী। সে হিসাবে তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে নতুন চাকরির সুপারিশ পেয়েছেন মাত্র ১৮ হাজার শিক্ষক। ফলে শিক্ষক শূণ্যতা আরও প্রকট হচ্ছে।

এ বিষয়ে এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান এনামুল কাদের খানের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য চেষ্টা করা হলে তিনি সাক্ষাৎ করেন নি।

বাংলাদেশ জার্নাল/এমএম/একে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত