ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২ মিনিট আগে
শিরোনাম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস

শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা সংকট নিরসন

  ছৈয়দ মোছাদ্দেকুন নবী, ঢাবি প্রতিনিধি

প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২২, ০৯:২২

শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা সংকট নিরসন
ছবি- প্রতিনিধি

আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। ১৯২১ সালের পহেলা জুলাই প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর গড়ে উঠা দেশের এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টি পা দিয়েছে তার ১০২ তম বছরে। প্রতিষ্ঠাকালীন তিনটি অনুষদ, ১২টি বিভাগ ও তিনটি আবাসিক হল নিয়ে যাত্রা শুরু করা বিশ্ববিদ্যালয়টি শতবর্ষ পার করে অনেকদূর এগিয়ে গেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারই জানান দিতে নানা আয়োজনে আজ পালিত হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস।

দিবসটি উদযাপন উপলক্ষ্যে বিগত কয়েকদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবন, কার্জন হল, কলা ভবন ও ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রসহ বিভিন্ন হল আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। এ নিয়ে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এবারের প্রতিপাদ্য–‘গবেষণা ও উদ্ভাবন: ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতা’। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান সকাল ১০ টায় শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের খেলার মাঠে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের বিভিন্ন কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল ১০টার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল হল ও হোস্টেল থেকে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ শোভাযাত্রা সহকারে শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের খেলার মাঠে সমবেত হবেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও হলসমূহের পতাকা উত্তোলন, পায়রা উড়ানো, কেক কাটা এবং সংগীত বিভাগের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে থিম সং পরিবেশিত হবে। এরপর সকাল ১১টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে ‘গবেষণা ও উদ্ভাবন: ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতা’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রাশুরুর এই দিনে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা সংকট নিরসন। শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সুযোগসুবিধা ও জীবনযাত্রার মান কতটুকু উন্নত সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে নতুন বছর থেকে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে এমনটাই প্রত্যাশা রাখছেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের কথা আসলে মৌলিক যে তিনটি বিষয় উঠে আসে সেগুলো হলো—থাকা, খাওয়া ও পড়া। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে পারেনি এই তিনটি মৌলিক চাহিদা, এমনটিই জানালেন হলের শিক্ষার্থীরা। এই দিবসে তাদের প্রত্যাশা সবার আগে আবাসন ব্যবস্থার উন্নয়নের উদ্যোগ নিবে ঢাবি প্রশাসন।

বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাসা নিয়ে থাকার সক্ষমতা না থাকায় হলে উঠতে বাধ্য হন বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। অন্যথায় এমন ‘বাজে অবস্থায়’ কেউ স্বাদে থাকে না। তাদের মতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে না আছে থাকার সুব্যবস্থা, না আছে ক্যান্টিনগুলোতে স্বাস্থ্যকর ও মানসম্মত খাবারের ব্যবস্থা, না আছে রিডিংরুমগুলোতে পড়ার জায়গা।

হলগুলোতে নেই থাকার সুব্যবস্থা:

স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর সর্বপ্রথম আবাসন সমস্যার মুখোমুখি হয় শিক্ষার্থীরা। সঙ্গতভাবেই প্রথমবর্ষ থেকেই হলে উঠার তোড়জোড় লেগে থাকে। কিন্তু এখানেই দীর্ঘদিনের স্বপ্নের সংঘর্ষ হয় বাস্তবতার সাথে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রথম বর্ষ ও অনেক হলে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে থাকার অনুমোদন দেয় না। বৈধ প্রক্রিয়ায় হলে উঠতে একজন ছাত্রের ন্যূনতম তৃতীয় বর্ষে পা দিতে হয়। ফলে প্রতিবছর একই ধরণে সমস্যায় পড়ে যায় ১ম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা শহরে নিজের ঠাঁই বানাতে অবলম্বন করতে হয় বিকল্প পদ্ধতি।

জানা যায়, প্রত্যেকটা হলেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন হলের কিছু রুম তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখেন। এ ক্ষেত্রে এখন গণরুমগুলো ছাত্রলীগের দখলে বলে জানান শিক্ষার্থীরা। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে প্রায় ১৭০ টি গণরুম ছাত্রলীগের দখলে আছে। ভর্তি হওয়া নতুন শিক্ষার্থীদের গণহারে সেই রুমগুলোতে তোলেন তারা। বিনিময়ে তাদের করতে হয় ছাত্রলীগের ‘প্রোগ্রাম’ ও ‘গেস্টরুম’। ৮ জনের রুমে থাকতে হয় ২০-৩০ জন, কিংবা তারও অধিক। ঠিক মতো ঘুমাতে না পেরে ক্লাসে যাবে সেই সুযোগটাও থাকে না অনেকসময়। দিনের বেলায় করতে হয় ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম (মিছিল-মিটিং)। শুধু এতটুকুতেই এসবের শেষ নয়। প্রোগ্রাম না করতে পারলে রাতে ‘গেস্টরুমে’ সিনিয়র ভাইদের হিসাব দিতে হয় দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের।

কবি জসীম উদ্দীন হলের দ্বিতীয় বর্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী তামজিদ হোসাইন বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘এরকম গাদাগাদি করে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের থাকতে হয় এটা কখনো মেনে নেয়া যায় না। রাতে ঘুমাতে না পারলে মনযোগ দিয়ে ক্লাস করা যায় না। প্রোগ্রাম-গেস্টরুম তো আছেই! আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলে অনেক আগেই হল ছেড়ে দিতাম। প্রত্যাশা থাকবে নতুন বছর থেকে আমাদের দিকে নজর দেবে প্রশাসন।’

ক্যান্টিনে নেই খাওয়ার পরিবেশ:

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খাবার নিয়ে অভিযোগ নতুন নয়। মানসম্মত খাবারের অপ্রতুলতার সাথে এখন যুক্ত হয়েছে মূল্য বৃদ্ধি। যার কারণে বেশি টাকা দিয়েও ভালো খাবার খেতে পারছে না হলের শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি ক্যান্টিনগুলোতে নেই স্বাস্থকর পরিবেশ ও সুষ্টু ব্যবস্থাপনা। দুর্গন্ধযুক্ত বাসি খাবার পরিবেশন সহ নানা অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।

বিজয় একাত্তর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আরমান শরীফ বলেন, ‘শুরুতে কয়েকদিন খাওয়ার পর আমি হল ক্যান্টিনে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। এখন এদিক-সেদিক বিভিন্ন দোকানে খাই। কখনো কখনো বাসি ও দুর্গন্ধযুক্ত খাবার পরিবেশন করা হয়। এক তরকারির সাথে অন্য তরকারির ঝোল দেয়া হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে প্রত্যাশা রাখা গাছের সাথে কথা বলার মতো। তবুও আশা করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের সংকট নিরাময়ের সংকল্প নেবে।’

হলের রিডিংরুমগুলোর ধারণক্ষমতা অপ্রতুল:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী বর্তমানে মোট শিক্ষার্থী আছে ৪৭ হাজার ১৯৭ জন। জানা গেছে ১৮ টি হলে বৈধভাবে প্রায় ১৭ হাজার শিক্ষার্থীর ধারণক্ষমতা আছে। তবে তার দ্বিগুণেরও বেশি শিক্ষার্থী নানা সংকটে পড়ে ও রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা নিয়ে বৈধ-‌অবৈধভাবে থাকছে। যার একটি বিশাল চাপ পড়ছে হলের রিডিংরুমগুলোর উপর। স্বাভাবিকভাবেই হলের রিডিংরুমগুলোতে এত শিক্ষার্থী ধারণের সক্ষমতা নেই। যার ফলে অনেকেই ভোর হতেই ভিড় জমায় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে। শেষমেশ সেখানেও জায়গা হয় না সবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মূল লক্ষ্য লেখাপড়া হলেও সেই সুযোগ যথাযথভাবে পায় না তারা। বিভিন্ন হলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বারান্দায় টুল-ব্যাঞ্চ বসিয়ে পড়ছেন অনেক শিক্ষার্থী।

হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বাংলাদেশ জার্নালকে জানান, ‘আমাদের হলের রিডিংরুমে অনেকসময় আমরা পড়ার জায়গা পাই না। দেখা যায় আশপাশের ছোট হলগুলো যেমন: এ এফ রহমান হল, বঙ্গবন্ধু হল থেকেও অনেকে এখানে পড়তে আসে। তুলনামূলক বড় হওয়ায় এখানে অনেকে ভিড় জমায়। যার কারণে সবার পড়ার সুযোগ হয় না।’

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, আবাসন সংকটের সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে রাজনীতির। হলের সংকটগুলোকে কৃত্রিম উল্লেখ করে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদেরকে জোর করে গণরুমে রাখা হয়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে সব হলেই অনেক মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থী থাকেন। রাজনৈতিক নেতারা তাদের সে ব্যবস্থা করে দেন। তারা ‌অ্যাকাডেমিক লেখাপড়া শেষ করে বিসিএস ও বিভিন্ন ধরণের চাকরির প্রস্তুতি নেন হলে অবৈধভাবে থেকে। তাদের কারণেই রিডিংরুমগুলোতে জায়গা হয় না।’বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দৃঢ় প্রচেষ্টা থাকলে এসব সংকট নিরসন করা কঠিন কিছু হবে না বলে মনে করেন তারা।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে পরিবেশ ও শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে নেয়া হয়েছে পূর্ণাঙ্গ ‘মাস্টার প্ল্যান’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, বৈশ্বিক নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে চলেছি। এর মাধ্যমে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণ হবে। প্রণিত ‘মাস্টার প্ল্যান’–এর আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, গুণগত মান ও গবেষণার পরিধি সম্প্রসারিত হবে।

বাংলাদেশ জার্নাল/ওএফ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত