ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

ফেসবুকে নাটক-সিনেমা প্রচারের নামে চাঁদাবাজি

  ইমরুল নূর

প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২১, ১৭:১৯  
আপডেট :
 ১৯ অক্টোবর ২০২১, ১৭:৪৬

ফেসবুকে নাটক-সিনেমা প্রচারের নামে চাঁদাবাজি

নাটক-চলচ্চিত্রকে ভিত্তি করে অনেকদিন ধরেই ফেসবুকে নানা রকম গ্রুপ গড়ে উঠেছে। উদ্দেশ্য প্রচার। দেশীয় নাটক ও চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনার মাধ্যমে এর মান ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তোলা। বলা চলে সেই প্রচেষ্টা বেশ ভালোভাবেই সফল। গেল কয়েক বছরে অনেক নাটক-সিনেমারই নাম নেয়া যাবে যেগুলো গণমাধ্যমের পাশাপাশি ফেসবুকের গ্রুপগুলোর হাত ধরে আলোচনায় এসে নতুন মাত্রা পেয়েছে। এসব গ্রুপের সদস্যরা নিঃস্বার্থভাবে দেশীয় নাটক-সিনেমা প্রতিনিয়ত লিখেন। যা প্রভাবিত করে সাধারণ দর্শককে।

তবে বেদনা ও পরিতাপের বিষয় হলো বেশিরভাগ গ্রুপই জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতাকে পূঁজি করে আজ নানা বিতর্কের মুখে রয়েছে। অভিযোগ আছে নাটক-চলচ্চিত্র ও তারকাদের প্রচারের বিনিময়ে চাঁদা দাবি করা হচ্ছে কিছু গ্রুপ ও পেইজ থেকে। এইসব চাঁদাবাজিতে জড়িয়েছেন জনপ্রিয় গ্রুপগুলোর অনেক অ্যাডমিন। যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় বিনোদন ভিত্তিক বিষয় নিয়ে লেখালেখির জন্য বেশ পরিচিত।

সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘পদ্মপুরাণ’ সিনেমার প্রচারণার বিনিময়ে সিনেমা ভিত্তিক কিছু গ্রুপ ও পেইজের এডমিন ছবিটির নির্মাতার কাছে আড়াই লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করেছেন বলে জানান পরিচালক রাশিদ পলাশ।

পরিচালক রাশিদ পলাশ বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘আমার ‘পদ্মপুরাণ’ সিনেমাটি মুক্তি দেওয়ার আগে প্রচারণার বিনিময়ে কয়েকজন আমার কাছে টাকা দাবি করে। টাকার অংক জানতে চাইলে তারা বলে যে, ‘আমাদের আড়াই লক্ষ টাকা লাগবে’। আমি তখন তাদেরকে জানিয়ে দেই যে, আমার পক্ষে সম্ভব না। আপনারা যদি সিনেমাপ্রেমী-ই হয়ে থাকেন তাহলে টাকা চাইছেন কেন? এমন কথা বলায় তারা জানান, অনেক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এবং পরিচালক পজেটিভ প্রচারণা করার বিনিময়ে তাদেরকে বিভিন্ন সময়ে মোটা অংকের টাকা দিয়ে থাকেন।

সিনেমা মুক্তির সময় সিনেমাসংশ্লিষ্ট এবং গণমাধ্যমের সবাইকে, এছাড়াও সিনেমাপ্রেমী যারা তাদের সবাইকে সিনেমাটি দেখার আমন্ত্রণ জানাই। অনেকেই ছবিটির জন্য শুভকামনা জানিয়েছেন এবং যারা ছবিটি দেখেছেন সবাই বেশ প্রশংসা করেছেন। কিন্তু সিনেমা ভিত্তিক গ্রুপগুলোতে দেখি আমার সিনেমাটি নিয়ে কয়েকদিন খুব নেগেটিভ প্রচারণা চালাচ্ছে কিছু স্বার্থসিদ্ধিরা। আমি রীতিমত অবাক হই। টাকা দেইনি বলে তারা আমার ছবিটি নিয়ে কিছুই লিখলো না!

ওরা অনেক খারাপ খারাপ ছবিকে নিয়েও ভালো বলে প্রচারণা চালায়। আমি টাকা দিতে পারিনি বলে এরা আমার সিনেমা নিয়ে ভালো কিছু লিখেনি। আমি খুবই মর্মাহত হয়েছি। এর মানে যারা তাদেরকে টাকা দিবে বা দেয় তাদের কাজ খারাপ হলেও সেটা নিয়ে তারা প্রচারণা চালায়!’

এ নির্মাতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘তাহলে কি এসব ফেসবুক ভিত্তিক সিনেমার গ্রুপগুলোর কাছে আমরা পরিচালকরা জিম্মি? এদেরকে টাকা দিলেই কিংবা এরা লিখলেই কি সিনেমা হিট হয়ে যাবে? তাহলে টাকা পেলে তো এরা তাদের মা-কেও বেঁচে দেবে, যদি এমন হয়? এদের কাছ থেকে আমরা কি আশা করতে পারি? এরা যাদের কাজ বা যাদের নিয়ে লেখে তার মানে তারা এদেরকে টাকা দেয়!

এদের পরিচয়ই বা কি যে, এরা বিভিন্ন গ্রুপ কিংবা পেইজ খুলে লেখার বিনিময়ে টাকা চান? এদেরকে দিয়েই যদি প্রচার করাতে হয় তাহলে এদেশে গণমাধ্যমের ভূমিকা কি? এরা কি গণমাধ্যমের চেয়েও বেশি কিছু? টাকা দিলে পজেটিভ লিখবে নাহলে নেগেটিভ প্রচারণা করবে বিভিন্ন গ্রুপে কিংবা পেইজে! একটা সিনেমা বানাতে অনেকের অনেক পরিশ্রম, টাকা ব্যয় হয় কাজটির পেছনে। কিন্তু এরা কিসের ভিত্তিতে এসব সিন্ডিকেট গড়ে তুলে? এরা কি বোদ্ধা? এরা তো ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংসের অন্যতম কিট! এদের অধিকাংশই কেউ স্ক্রিপ্ট লিখতে চান, কেউ গান লিখতে চান, কেউবা অভিনয় করতে চান; তাদেরকে সুযোগ না দিলে তারা উল্টো হয়ে নেগেটিভ লেখা শুরু করে। এদের মুখোশ সবার সামনে তুলে ধরা উচিত, যারা মুখোশের আড়ালে এসব চাঁদাবাজি করে বেড়ায়!’

এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন কি? এমন প্রশ্নে নির্মাতার উত্তর, ‘আমি নির্মাতার বাইরেও একজন গণমাধ্যমকর্মী। এই বিষয়টিতে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই মর্মাহত হয়েছি। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের বিরুদ্ধে অতি শীঘ্রই আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

শুধু তাই নয়, নাটক সিনেমা ভিত্তিক এরকম বিভিন্ন গ্রুপগুলোর অনেকেই সিন্ডিকেট মেইনটেইন করে কাজ নিয়ে পজেটিভ কিংবা নেগেটিভ রিভিউ, আলোচনা-সমালোচনা বিষয়ক বিভিন্ন পোস্ট দেন বলেও অভিযোগ জানিয়েছেন অনেক পরিচালক।

জনপ্রিয় নির্মাতা শিহাব শাহীন বলেন, ‘এসব গ্রুপ বা পেইজগুলো যারা চালায়, তাদের যোগ্যতা কি? তারা নাটক-সিনেমা সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান রাখে? এরা তো ক্রিটিকস না। এরা সিনেমার ফিলোসফি সম্পর্কে কতটুকু জানে? সাহসই বা পায় কি করে কোনো পরিচালক বা শিল্পীকে নিয়ে কোনো কিছু বলার বা লিখার? এরা তো অযোগ্য। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘এরকম অনেক গ্রুপই আছে কিন্তু সবাই একরকম না। কেউ কেউ নিউট্রাল জায়গায় থেকে ভালটাকে ভালো এবংমন্দটাকে মন্দই বলেন। তবে এদের মধ্যে সবাই না, কিছু গ্রুপ কিংবা সদস্য আছে যারা এসব বাজে কর্মকাণ্ডগুলো করে থাকে।

আমার ‘মরীচিকা’ কন্টেন্ট রিলিজের সময় দুইটা গ্রুপ থেকে আমার কাছে কয়েকজন টাকা চায়। আমি তাদেরকে কোনো টাকা দেইনি, এরজন্য অনেকে আমাকে দেখতে পারে না। আমার কোনো কাজ নিয়ে তারা লিখে না, লিখলেও সেটা নেগেটিভ। এদের লিখার উপর তো আর একজন শিহাব শাহীন তৈরি হয়নি। আমি কাকে নিয়ে কাজ করবো নাকি না; কিংবা কি বানাবো? আমি তো সেসব গ্রুপ, পেইজের ধারে কাছেও নেই। এরা একটা চক্র। এই বাজে চক্রদের মুখোশ উন্মোচন জরুরী।’

চলচ্চিত্র নির্মাতা মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ বলেন, ‘নাটক-সিনেমা ভিত্তিক গ্রুপ তো খারাপ না, কিন্তু উদ্দেশ্য যদি খারাপ হয় তাহলে সেটা ক্রাইম। কেউ পছন্দের হলে তাকে নিয়ে সারাক্ষণ ভালো কথা আর অপছন্দের হলেই নেগেটিভ; এই ধরণের মানসিকতা কেন?

আমার সিনেমা রিলিজের সময় বাংলা চলচ্চিত্র গ্রুপের একজন আমার কাছে টাকা চেয়েছে। অথচ টাকা চাওয়ার আগের দিন আমার কাজ নিয়ে নেগেটিভ প্রচার করেছে। টাকা দরকার তার, কিন্তু এমনভাবে বলছিলো যেন, সে আমাকে অর্ডার দিচ্ছে। আমি তাকে টাকা দেইনি। যার ফলে সে আমাকে নিয়ে কিংবা আমার কাজ নিয়ে পজেটিভ লিখে না। এগুলো তো খুবই খারাপ কাজ।

এছাড়াও নাটক গ্রুপগুলোতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম লেখা দেখি। কেউ কাজ দেখে তার মতামত জানাতেই পারে কারণ তারা দর্শক। কিন্তু তারা যেভাবে লিখে মনে হয় তারা যেন ক্রিটিকস! এরা সবাইকে জ্ঞ্যান দিতে আসে। এমনও হয়েছে যে, শুটিংয়ের দিনের ছবি দিয়ে তারা পোস্ট করে লিখে, আরেকটা গার্বেজ কাজ আসতেছে। কাজটা তো রিলিজই হয়নি তাহলে সে কিভাবে জানে যে, এটা গার্বেজ! এরা এসব লিখার সাহসই পায় কোথা থেকে? এগুলো বন্ধ হওয়া উচিত।’

আরেক জনপ্রিয় নাট্য নির্মাতা মাবরুর রশীদ বান্নাহ বলেন, ‘এসব তো অনেক দিন ধরেই হয়ে আসছে। এরা হচ্ছে কারো কারো জন্য চাঁদাবাজ। আমার কাছে কোনো সময় কেউ টাকা পয়সা চাওয়ার সাহস করতে পারেনি। আমার সঙ্গে যেটা হয়, সেটা হচ্ছে, আমার কোনো কাজকে এরা মূল্যায়ন করে না। আমাকে নিয়ে কিংবা আমার কাজকে নিয়ে কেউ কোনো পজেটিভ লিখলে সেগুলো অনেক সময়ই এপ্রুভ হয় না। অনেকেই এগুলো আমাকে জানিয়েছেন। এখন আমার কথা হলো, এদের পরিচয় কি? এরা আমাকে কিংবা আমার কাজকে মূল্যায়ন করার কি যোগ্যতা রাখে? এরা লিখলে কি হবে আর না লিখলেই কি হবে? আমার একটা প্রশ্ন, কোনো পরিচালক, প্রযোজক কিংবা শিল্পীর লক্ষ্য কি এটা হওয়া উচিত? যে, আমাকে নিয়ে অমুক তমুক লিখুক। এটা তো রুচির প্রশ্ন, শিক্ষার প্রশ্ন! অযোগ্যদের একটা পোস্টের ওপর যদি কারো মূল্যায়ন নির্ভর করে তাহলে সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

আরও একটা বিষয় বলতে চাই সেটা হলো, এই যে বিভিন্ন পোস্টে শিল্পী এবং পরিচালকসহ অনেককে কিছু মানুষ হেয় করে তুলে ধরেন, তাদেরকে মানুষের কাছে নিচু করে উপস্থাপন করেন; এগুলো কতটা যৌক্তিক? এটা আমার মানবিক প্রশ্ন তাদের প্রত্যেকের কাছে। যাদেরকে ছোট করে, নিন্দা করে, ব্যঙ্গ করে নানারকম পোস্ট করে এদের কি মানবতা নেই? এদের কি একবারও মনে হয় না যে, যাকে নিয়ে এত বাজেভাবে লিখছে; তার ভিতর দিয়ে কি যাচ্ছে? কিংবা তার পরিবারের মধ্যে কি অতিবাহিত হচ্ছে?

একজন শিল্পীকে নিয়ে যে কেউ যা ইচ্ছা তা কমেন্ট করে ফেলছে, অনেকের সামনে নেতিবাচক উপস্থাপন করছে কিংবা অভিনয় নিয়ে নানারকম বাজে মন্তব্য করছে। সেই শিল্পীর বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুদের চোখে যখন এসব বিষয়গুলো পড়ে তখন তাদের মধ্যে কি অবস্থা বিরাজ করে; সেটা কি কেউ একবার ভেবে দেখে? সমালোচনারও যৌক্তিক এবং মার্জিত ভাষায় হতে পারে এটা সবারই বোঝা উচিৎ। এবং এটাই কাম্য ।’

বাংলাদেশ জার্নাল/আইএন

  • সর্বশেষ
  • পঠিত