ঢাকা, রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১০ মিনিট আগে
শিরোনাম

বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ-এর পরিচালক আবদুল জব্বার খান

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:৪৫

বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ-এর পরিচালক আবদুল জব্বার খান
আবদুল জব্বার খান

বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা এবং চিত্রনাট্যকার ও পূর্ব বাংলার বাংলা চলচ্চিত্রের জনক হিসেবে সমাদৃত আবদুল জব্বার খান। তার চিত্রনাট্য, অভিনয় এবং পরিচালনায় "মুখ ও মুখোশ" চলচ্চিত্র তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র হিসেবে পরিচিত।

অসামাজিক কর্মকাণ্ড, পারিবারিক কলহ ও দুর্নীতির মতো বিষয়বন্তু নিয়ে 'মুখ ও মুখোশ' নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র এটি। এর দৈর্ঘ্য ৯৯ মিনিট। অনেক চড়াই-উৎরাই পারি দিয়ে অবশেষে ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট ছবিটি মুক্তি পায়। ছবির প্রথম প্রদর্শনী রূপমহল সিনেমা হলে উদ্বোধন করেন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। তৎকালীন পুরান ঢাকার 'মুকুল' সিনেমা হলে ছবিটির শো চলে। পরে ছবিটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও নারায়ণগঞ্জসহ অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেয়া হয়।

এরপর 'মুখ ও মুখোশ' নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। বাংলার নিজস্ব ছবি দেখার জন্য সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে দর্শক। বাঙালিদের মধ্যে সিনেমা নিয়ে আবেগ ও উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়। সিনেমা শুধু বিনোদন নয়, প্রতিবাদে হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় ছিলেন চট্টগ্রামের মেয়ে পূর্ণিমা সেন, ইনাম আহমেদ ছিলেন নায়কের ভূমিকায়, আব্দুল জব্বার খান অভিনয় করেন দ্বিতীয় প্রধান পুরুষ চরিত্রে। তবে অন্য নারী চরিত্রে অভিনয় নিয়ে তৈরি হয় বিপত্তি। ওই সময় ছবিতে নারীদের অভিনয় করা ভালো চোখে দেখা হত না। ফলে সিনামায় অভিনয়ের জন্য পরিবার থেকে নারীদের অনুমতি পাওয়া ছিল কষ্ট সাধ্য কাজ।

তাই ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো। বিজ্ঞাপন দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রী জহরত আরা ও ইডেন কলেজের ছাত্রী পিয়ারী বেগম আগ্রহ দেখান। এরপর অনেক জটিলতা উপেক্ষা করে তাদের ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবিতে অভিনয় করানো হয়। এছাড়া এই ছবিতে অভিনয় করেন- সাইফুদ্দিন, বিনয় বিশ্বাস, রহিমা খাতুন, বিলকিস বারী, আমিনুল হক, আলী মনসুর, রফিক, নুরুল আনাম খান প্রমুখ। চলচ্চিত্রটির সংগীত পরিচালনা করেন সমর দাস। গানে কণ্ঠ দেন আবদুল আলীম ও মাহবুবা হাসনাত। সহকারী সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন ধীর আলী, শব্দগ্রহণে ছিলেন মইনুল ইসলাম। ছবিটি সম্পাদনা করেন আব্দুল লতিফ। আর পোস্টার ডিজাইন করেন সুভাষ দত্ত। উপদেষ্টা চিত্রগ্রাহক ছিলেন মুরারী মোহন। অঙ্গসজ্জার কাজ করেন শ্যাম বাবু। আর পরিবেশনায় ছিল ইকবাল ফিল্মস লি.। ছবিতে একই সঙ্গে পরিচালক, প্রযোজক, রচয়িতা ও অভিনেতা হিসেবে ছিলেন ‘মুখ ও মুখোশ’-এর প্রধান স্রষ্টা আব্দুল জব্বার খান।

আব্দুল জব্বার খান বাংলা ১৩২২ সালের ৭ই বৈশাখ (১৯১৬ ইং) তারিখে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার উত্তর মসদ গাঁও নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাজী মোহাম্মদ জমশের খান। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।

আসামের ধুবড়ী এলাকায় তার বাবা পাটের ব্যবসা করতেন। সেখানেই শৈশবে তিনি স্কুলে ভর্তি হন। পাঠ্য অবস্থায় জড়িয়ে পড়েন নাটকের সঙ্গে। তিনি অভিনয় করেন "বেহুলা", "সোহরাব রোস্তম" নাটকে। প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত "সিন্ধু বিজয়" নাটকেও তিনি অভিনয় করেন। নবম-দশম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই তিনি নাটকের মূল চরিত্রে অভিনয় করেন।

প্রমথেশ বড়ুয়ার সাথে পরিচয়ের সূত্রে তিনি কলকাতায় গিয়ে তার বাসায় থেকে নাটক দেখতেন। প্রমথেশ বড়ুয়ার "মুক্তি" চলচ্চিত্রে আব্দুল জব্বার খানের অভিনয়ের কথা থাকলেও প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে পরে তিনি তা করতে পারেননি। পরে তিনি প্রমথেশ বড়ুয়ার "শাপ মুক্তি" চলচ্চিত্রের জন্য নির্বাচিত হন কিন্তু পিতার কাছ থেকে অণুমতি না পাওয়াতে তিনি সে চলচ্চিত্রটিও করতে পারেননি। তবে তিনি নিয়মিত মঞ্চনাটক করেছেন। তিনি "সমাজপতি ও মাটির ঘর" নাটকে অভিনয় করে স্বর্ণপদক পান। গৌহাটিতে পরিচালনা করেন "টিপু সুলতান"। ১৯৪১ সালে আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল থেকে ডিপ্লোমা নিয়ে চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকায় স্থায়ীভাবে চলে আসেন। ঢাকায় এসে সংগঠিত করেন 'কমলাপুর ড্রামাটিক এসোসিয়েশন'। এ সংগঠনের উদ্যোগে তিনি "টিপু সুলতান" ও "আলীবর্দী খান" নাটক মঞ্চায়ন করেন। পরে তিনি "ঈসাখাঁ" (১৯৫০), "প্রতিজ্ঞা" (১৯৫১), "ডাকাত" (১৯৫৩),"জগোদেশ" (১৯৫৯) রচনা করেন।

১৯৫৬ সালে তার রচিত নাটক "ডাকাত" (পরবর্তীতে উপন্যাস হিসেবে প্রকাশিত) অবলম্বনে তৈরি করেন "মুখ ও মুখোশ" নামক চলচ্চিত্র। "মুখ ও মুখোশ"-ই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ( বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে তৈরি প্রথম সবাক চলচ্চিত্র। এ চলচ্চিত্রটি তিনি পরিচালনার সাথে সাথে এর মূল চরিত্রেও অভিনয় করেন। এ চলচ্চিত্রে তার ছেলেবেলার চরিত্রে অভিনয় করেন তার ছেলে মাস্টার জুলু। এরপর তিনি পরিচালনা করেন "জোয়ার এলো" (১৯৬২), উর্দূতে "নাচ ঘর" (১৯৬৩), "বনসারি" (১৯৬৮), "কাচঁ কাটা হীরা" (১৯৭০), "খেলারাম" (১৯৭৩) চলচ্চিত্র।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আব্দুল জব্বার খান মজিব নগর সরকারের চলচ্চিত্র প্রদর্শন ও পরিবেশনার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। তিনি পরবর্তীতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জুরি বোর্ড, অণুদান কমিটি, সেন্সর বোর্ড, ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভে সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ষাট দশকের প্রথম ভাগে গঠিত পাকিস্তান পরিচালক সমিতির অন্যতম সংগঠক ছিলেন।

মুখ ও মুখোশ চলচ্চিত্র মুক্তির পর তিনি তেমন কোন স্বীকৃতি পাননি। কেবলমাত্র এফডিসিতে তার নামে একটি পাঠাগার রয়েছে। পরিচালক সমিতির আবেদনের প্রেক্ষিতে বর্তমান সরকারের কাছে আবেদন করায় ঢাকার সোনারগাঁও সার্ক ফোয়ারা থেকে এফডিসি ছাড়িয়ে টঙ্গী ডাইভারশন রোড পর্যন্ত সড়কটি 'আবদুল জব্বার খান সড়ক' নামে পরিচিত হবে। অবশেষে ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর একুশে পদক ভূষিত করে।

আব্দুল জব্বার খান ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর ২৮ তারিখে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় নিজের বাসায় মৃতুবরণ করেন।

বাংলাদেশ জার্নাল/এমএস

  • সর্বশেষ
  • পঠিত