ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩৯ মিনিট আগে
শিরোনাম

সত্যজিৎ রায়: বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ০২ মে ২০২২, ০৯:১০

সত্যজিৎ রায়: বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র
সত্যজিৎ রায়

সত্যজিৎ রায় ছিলেন একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সংগীত পরিচালক এবং লেখক। তাকে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯২১ সালের ২ মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন সত্যজিৎ রায়। জন্মের মাত্র তিন বছর বয়সেই বাবা সুকুমার রায়ের মৃত্যু হয়। মা সুপ্রভা দেবী বহু কষ্টে তাকে বড় করে তোলেন। সত্যজিৎ কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতিতে পড়াশোনা শুরু করেন। যদিও চারুকলার প্রতি ছিল তার গভীর দুর্বলতা। ১৯৪০ সালে মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি।

বিশ্বভারতীতে পড়াশোনা শেষে সত্যজিৎ কলকাতায় চলে আসেন। পরে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ‘ডি জে কিমার’-এ জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪৩ সালের দিকে তিনি প্রকাশনা সংস্থা ‘সিগনেট প্রেস’এর সঙ্গে জড়িত হন। এই প্রকাশনী থেকে বের হওয়া বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকাই ছিল তার কাজ।

সিগনেট প্রেস থেকে বের হওয়া প্রচুর বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করেন তিনি। যার মধ্যে জিম করবেটের ‘ম্যানইটার্স অব কুমায়ুন’ ও জওহরলাল নেহেরুর ‘দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ উল্লেখযোগ্য। আর বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র শিশুতোষ সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’ও এই প্রকাশনী থেকে বের হয়েছিল। বইটির প্রচ্ছদ আঁকার দায়িত্ব পড়ে সত্যজিতের উপর। প্রচ্ছদ আঁকার আগে উপন্যাসটি পড়েন তিনি। উপন্যাসটি সত্যজিৎকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। প্রচ্ছদ আঁকা ছাড়াও তিনি বইটির ভেতরের বিভিন্ন ছবিও এঁকে দেন। পরবর্তীতে সত্যজিত রায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় ‘পথের পাঁচালী’কে বেছে নেন। বইয়ের ভেতরে আঁকা ছবিগুলোই পরে দৃশ্য বা শট হিসেবে তার সাড়া জাগানো চলচ্চিত্রে স্থান পায়।

১৯৪৭ সালে অন্যদের সঙ্গে মিলে তিনি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ফিল্ম সোসাইটি। সোসাইটির কল্যাণে বিশ্বের বহু বিখ্যাত ছবি দেখেন। ছবি দেখতে দেখতেই একসময় ছবি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তবে ১৯৪৮ সালে মুক্তি পাওয়া ইতালির পরিচালক ভিট্টোরিয় ডি সিকার অমর চলচ্চিত্র 'বাইসাইকেল থিফ' দ্বারা চলচ্চিত্র নির্মাণে তিনি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হন।

১৯৫২ সালের শেষ দিকে সত্যজিৎ তার নিজের জমানো টাকায় ‘পথের পাঁচালী’ ছবির দৃশ্যগ্রহণ শুরু করেন। ভেবেছিলেন প্রাথমিক দৃশ্যগুলো দেখার পর হয়তো কেউ ছবিটিতে অর্থলগ্নি করতে এগিয়ে আসবেন। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। তবে তিনি থেমে যাননি। ধীর গতিতে কাজ চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে ঋণ নিয়ে ১৯৫৫ সালে ছবিটির নির্মাণ শেষ করেন। ওই বছরই ছবিটি মুক্তি পায়।

মুক্তির পর পরই ছবিটি দর্শক-সমালোচকদের ব্যাপক প্রশংসা পান। কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্টারি’ক্যাটাগরিতে ছবিটি পুরস্কৃত হয়। এ ছাড়াও ১১টি আর্ন্তজাতিক পুরস্কার পায় সিনেমাটি। এই ছবির মাধ্যমেই চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের দীর্ঘ পথচলার শুরু হয়। আর পরবর্তী ছবি ‘অপরাজিত’ তাকে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়। ছবিটি ইতালির ভেনিসের বিখ্যাত গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার জিতে।

এরপর তিনি একে একে নির্মাণ করেন ‘অপুর সংসার’, ‘পরশপাথর’, ‘জলসাঘর’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘চারুলতা’, ‘দেবী’, ‘মহানগর’, ‘অভিযান’, ‘কাপুরুষ’, ‘মহাপুরুষ’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘সীমাবদ্ধ’, ‘জনারণ্য’, ‘হীরক রাজার দেশ’, ‘গণশত্রু’, ‘আগন্তুক’, ‘শাখা প্রশাখা’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ও ‘আগুন্তক’। আর ডকুমেন্টারি ফিল্ম, শর্ট ফিল্ম, ফিচার ফিল্মসহ সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছেন মোট ৩৭ টি ছবি।

পথের পাঁচালি থেকে আগন্তুক, দীর্ঘ এক চলচ্চিত্রকারের জীবন তার। সেলুলয়েডে আলোছায়ার ব্যঞ্জনায় উপন্যাসের কাহিনী ও পরিবেশ বর্ণনা, দ্বন্দ্ব, সুরের ছন্দকে খুব সাবলীলভাবে সাজাতেন তিনি। ফ্রেমের সুনিপণ ও নান্দনিক গাথুনির ঢংয়ে গেঁথেছেন অমর সব মালা। ফ্রেমে বেঁধেছেন মানুষের জীবন।

অমর এই ছবির কবির চলচ্চিত্র ছিল মূল প্লাটফর্ম। শিল্প-সাহিত্যের অন্যসব শাখায়ও ছিল সফল পদচারণা। যেখানে হাত দিয়েছেন দুহাতে মুক্তো ফলিয়েছেন। লিখেছেন ছোটগল্প। চলচ্চিত্র নিয়েও লিখেছেন বেশ কিছু বই। ‘আওয়ার ফিল্মস’, ‘দেয়ার ফিল্মস’, ‘বিষয়: চলচ্চিত্র’, ও ‘একেই বলে শুটিং’বইগুলোতো আজো চলচ্চিত্রে আগ্রহী যে কারো কাছে প্রিয়। চিত্রশিল্পী হিসেবে সত্যজিৎ রায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। নিজের লেখা সব বইয়ের প্রচ্ছদ ও ভেতরের ছবি তিনি নিজেই একেঁছেন। নিজের চলচ্চিত্রের সব বিজ্ঞাপনও নিজেই তৈরি করতেন তিনি ।

১৯৮৩ সালে ‘ঘরে বাইরে’ ছবির কাজ করার সময় সত্যজিৎ রায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়। এতে তার কাজের গতি কমে যায়। প্রায়ই তিনি অসুস্থ থাকতেন। ১৯৯২ সালে আবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন সত্যজিৎ রায়। এ সময় হাসপাতালের বেডে শুয়ে তিনি পেন্সিলে আঁকেন একটি গাছের স্কেচ। যার মধ্যে ছিল উপমহাদেশের ১১জন বিখ্যাত মনীষীর মুখাবয়ব।

১৯৯২ সালে মৃত্যুর মাত্র একসপ্তাহ আগে বিশ্ব চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সন্মানজনক অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান সত্যজিৎ রায়। একই বছর ভারত সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন প্রদান করে। এ ছাড়াও জীবদ্দশায় তিনি ৩২টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেন।

আর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে পেয়েছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি। যা প্রথম চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে পেয়েছিলেন চার্লি চ্যাপলিন। ১৯৮৫ সালে ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান।

সেলুলয়েডের অমর এই কবি বাংলা বা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসেই নয়, বিশ্ব-চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। ‘রশোমন’খ্যাত বিশ্ববরেণ্য জাপানি চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরোসাওয়া সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এই পৃথিবীতে বাস করে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র না দেখা চন্দ্র-সূর্য না দেখার মতোই অদ্ভুত ঘটনা।’

২০০৪ সালে, বিবিসির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি তালিকায় সত্যজিৎ ১৩তম স্থান লাভ করেছিলেন।

বাংলাদেশ জার্নাল/এমএস

  • সর্বশেষ
  • পঠিত