ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

রাজনীতি ছাড়ছেন ‘ইউরোপের রানি’

  আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৩:৪১

রাজনীতি ছাড়ছেন ‘ইউরোপের রানি’
জার্মান চেন্সেলর এঙ্গেলা মরকেল। ছবি: ডয়চে ভেলে

আনুষ্ঠানিক রাজনীতি থেকে অবসরে যাচ্ছেন জার্মান চেন্সেলর এঙ্গেলা মরকেল। ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি এমন অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা শতবর্ষ পরেও মানুষ মনে রাখবে। তিনি ছিলেন ইউরোপের ক্রাইসিস ম্যানেজার। তাই তাকে ইউরোপের রানিও বলা হয়।

জার্মানিতে আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের পরই বিদায় নিচ্ছেন মরকেল। মঙ্গলবার বিবিসির খবরে বলা হয়, অনেক আগেই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি আর চ্যান্সেলর পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। তবে তার এই বিদায় কি রানির মত বিদায়ই হবে?

এঙ্গেলা মরকেল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বর্তমান নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে নেতৃত্বে থেকেছেন। তিনি প্রায় ১০০টি ইইউ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। মাঝে মাঝে তাকে বলা হতো - মরকেলই সম্মেলন কক্ষের একমাত্র বয়স্ক ব্যক্তি।

ইইউকে বহু সংকট পার হতে সহায়তা করেছেন তিনি। অভিবাসন সংকট, ইউরো সংকট, কোভিড-১৯, এমনকি কিছুটা ব্রেক্সিটের ক্ষেত্রেও। কিন্তু মরকেলের রাজনৈতিক জীবন আসলে দুই ভাগে বিভক্ত। ইউরোপের নেতা হিসেবে যেমন, তেমনি জার্মানির নেতা হিসেবেও তার উত্তরাধিকার আসলে ভালো-মন্দ মিলিয়ে।

জার্মানিতে মরকেলের সমালোচনা হয় এ জন্যে যে, গত ১৬ বছরের শাসনকালে তিনি ছিলেন একজন ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’। সংকট সামাল দেবার জন্য তিনি অপেক্ষা করতে করতে একেবারে শেষ মুহূর্তে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন। বলা হয়, তিনি একজন বাস্তববাদী, কিন্তু দ্রষ্টা নন।

এই সমালোচকরা বলেন, ইউরোপের নেত্রী হিসেবেও তিনি এই একইভাবে কাজ করেছেন। বলা যায়, এঙ্গেলা মরকেল যা করেছেন তার অভিঘাত - তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেবার পরও বহুদিন অনুভূত হবে।

ইইউর ক্রাইসিস ম্যানেজার: মরকেলের বাস্তববুদ্ধি অনেক সময় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে বহু সংকট পার হয়ে আসতে সহায়তা করেছে, যা কখনো কখনো ইইউর অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে পারতো। কিন্তু অনেকে পাল্টা যুক্তি দেন, তার দূরদর্শিতার অভাব এ ইউনিয়নকে আগের চাইতে দুর্বলতর এবং দিকনির্দেশনাহীন করে ফেলেছে।

এটা হতো না, যদি ইইউর সবচেয়ে ধনী এবং প্রভাবশালী দেশের নেতা হিসেবে এঙ্গেলা মরকেল তার অবস্থানকে আরও জোরের সাথে কাজে লাগাতেন।

ধরা যাক ২০১৫ সালের ইউরোজোনের সংকটের কথা। এমনকি গ্রিসের ক্ষ্যাপা অর্থমন্ত্রী ইয়ানিম ভারুফাকিসও স্বীকার করেন, তার দেশের আর্থিক দুরবস্থা সত্বেও গ্রিসকে ইউরোজোনের ভেতরে রেখে মরকেল আসলে ইউরো মুদ্রাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘এটা সত্যি যে শেষ পর্যন্ত আঙ্গেলা মের্কেলের জন্যই ইউরোজোন টিকে গেছে। কারণ, গ্রিস যদি এখান থেকে বেরিয়ে যেতো তাহলে ইউরোজোনকে একসাথে রাখা সম্ভব হতো বলে আমি বিশ্বাস করি না।’

তিনি বলেন, ‘কিন্তু যে নীতি তিনি অনুসরণ করেছেন তা নিয়ে আমার গুরুতর ভিন্নমত আছে। ইউরোজোন নিয়ে, বা একে রক্ষা করার পর এটাকে নিয়ে কি করতে হবে, তার ব্যাপারে তার কোন রূপকল্প ছিল না। তিনি যেভাবে এটাকে রক্ষা করেছেন তা জার্মানির ভেতরে এবং গ্রিসের ভেতরেও অনেক বিভক্তি সৃষ্টি করেছে।’

ভারুফাকিস এ সময় গ্রিসের কৃচ্ছসাধনের কর্মসূচির উদ্ধৃতি দিলেন, যা চাপিয়ে দেবার পেছনে জার্মানিরই প্রধান ভুমিকা ছিল।

সবার আগে জার্মানি? অর্থনৈতিক কৃচ্ছতার কর্মসূচি চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল স্পেন আর ইতালির ওপরও। এ দেশগুলোর করদাতাদের অনেকের মতে, এ কর্মসূচি ছিল অতি কঠোর এবং তাদের বিশ্বাস ছিল, এটা চাপিয়ে দেবার পেছনে ছিলেন এঙ্গেলা মরকেলই।

ফলে এক সময়কার ইউরো-প্রেমিক ইতালিতে ইইউ-এর ব্যাপারে সন্দেহ জোরালো হয়ে ওঠে। ক্রুদ্ধ ভোটারদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়, ইউরোজোনের নীতিমালাগুলো তৈরিই হয়েছে ক্ষমতাধর জার্মানির স্বার্থ রক্ষা করতে, তাদের রপ্তানি শিল্পকে আনুকুল্য দিতে।

এরা প্রশ্ন তোলেন, জার্মানির মত ক্ষমতাধর ও ধনী সদস্যরা যদি দুর্বলতর দেশগুলোকে সাহায্য না করে তাহলে ইইউতে বা কমন মার্কেটে থাকার দরকার কি? কিছু সমালোচক আছেন যারা মনে করেন, ইউরোপে এঙ্গেলা মরকেলের আসল নীতি হচ্ছে ‘সবার আগে জার্মানির স্বার্থ’ দেখা।

অনেকে হয়তো বলবেন, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ, একজন নির্বাচিত নেতা তো তার দেশের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেবেন। তবে অন্য একটা কারণ আছে, যা জার্মানির একান্ত নিজের একটি সমস্যা। সেটা হলো জার্মানির নাৎসী অতীত। জার্মানরা এবং জার্মান চ্যান্সেলররাও - এ কারণে প্রায়ই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চোখে পড়ার মত প্রধান নেতৃত্বের ভুমিকা নিতে অস্বস্তি বোধ করেন।

‘গেম চেঞ্জার’ মরকেল: তাহলে প্রশ্ন ওঠে - এঙ্গেলা মরকেলকে যে ইউরোপের রানি বলা হয় - ব্যাপারটা কি আসলে সে রকমই? ইউরোজোনকে রক্ষা করতে চ্যান্সেলর মরকেল হস্তক্ষেপ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার ফলে তিনি ইইউর ভেতরে একটা গভীর উত্তর-দক্ষিণ বিভক্তিও উস্কে দিয়েছিলেন।

এর পরবর্তীকালে অভিবাসন সংকটের সময় এবং কোভিড মহামারির সময়ও এ বিভক্তি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। ইউরোপের দক্ষিণের দেশগুলোর মানুষ মনে করেছিলেন, এসব জরুরি পরিস্থিতির দুর্ভোগ তাদেরকেই বহন করতে হয়েছে, ইইউর অন্য দেশগুলো তাদের খবর নেয়নি।

কিন্তু এ অবস্থা বেশিদিন চলেনি। অনেকটা দেরিতে হলেও গঠিত হয় কোভিড-সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য একটি তহবিল, যাতে সেই এঙ্গেলা মরকেলই এক প্রধান ভুমিকা রেখেছিলেন।

ইইউর কোভিড রিকভারি ফান্ডের অন্যতম প্রণেতা ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী ব্রুনো লা মেয়ার বলেন, চ্যান্সেলার মরকেল এক্ষেত্রে সাহস দেখিয়ে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং বুঝেছিলেন - ওই তহবিলে জার্মানি যোগ না দিলে ইইউর ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে।

অনেকে আবার এটিকে এভাবেও দেখেন যে, এঙ্গেলা মরকেল এ ক্ষেত্রেও আসলে জার্মানির স্বার্থই দেখেছিলেন। কারণ, তিনি বুঝেছিলেন যে মহামারির কারণে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স বা অন্য দেশগুলো যদি অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয় - তাহলে ইউরোপের একক বাজারই শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়বে। আর সেই বাজার ভেঙে পড়লে জার্মানির ব্যবসাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

মানবাধিকার রেকর্ড: এঙ্গেলা মরকেল যখন ২০১৫ সালের গ্রীষ্মে জার্মানির সীমান্ত খুলে দিয়ে ১০ লাখেরও বেশি শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীকে সে দেশে ঢুকতে দিলেন, তখন তিনি প্রশংসিত ও নিন্দিত দুটোই হয়েছিলেন। জার্মানির মানুষের একাংশ অন্যদের স্বাগত জানানোর সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য মরকেলের প্রশংসা করেন।

কিন্তু অন্যরা এত অভিবাসীর আগমন দেখে ক্ষিপ্ত হন। তারা দলে দলে যোগ দেন উগ্র-দক্ষিণপন্থী এএফডি-র সাথে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মত ফেডারেল পার্লামেন্টে কোন উগ্র-দক্ষিণপন্থী দল আসন জিততে সক্ষম হয়। ইইউ-র ওপর এর প্রতিক্রিয়া হয় ব্যাপক ও মিশ্র।

২০১৫ সালে সীমান্ত খুলে দিয়ে সিরিয়ার ১০ লাখের বেশি শরণার্থী গ্রহণ করে জার্মানি। এক সিরীয় শরণার্থী হাতে মরকেলের ছবি।

ইইউ ২০১২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিল, কিন্তু তার মাত্র তিন বছর পরই এর সদস্য দেশগুলো সিরিয়াসহ নানা দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের ঠেকাতে তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিতে থাকে। তবে জার্মান নেতার পদক্ষেপের ফলে মানবাধিকারের রক্ষক হিসেবে ইইউর যে সুনাম ছিল তা পুনরুজ্জীবিত হয়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ডান হাত এবং তার ডেপুটি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্বে থাকা বেন রোডস জানান, মরকেলে অনুপ্রাণিত ছিলেন বারাক ওবামাও।

রোডসের মতে, ওবামা মরকেলকে উৎসাহিত করেন ইউরোপের পক্ষে আরও জোরালো অবস্থান নিতে, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় আর ব্রেক্সিট ভোটের পর। তিনি আরও এক মেয়াদ চ্যান্সেলর থাকতেও তাকে চাপ দেন।

রোডস বলছিলেন, ২০১৬ সালের শেষ দিকে ওবামার মনে হয়েছিল যে, মরকেলের জার্মানিই হতে যাচ্ছে উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভরকেন্দ্র।

বাংলাদেশ জার্নাল / টিটি

  • সর্বশেষ
  • পঠিত