ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

আফগানিস্তানে তালেবান: দৃশ্যপটে নেই সৌদি

  আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:৪৫

আফগানিস্তানে তালেবান: দৃশ্যপটে নেই সৌদি
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: বিবিসি

ইসলামী দুনিয়ায় সৌদি আরবের প্রভাব প্রতিপত্তি এবং প্রাসঙ্গিকতা যে ক্রমাগত কমছে, আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে সেই বাস্তবতা যেন আরও বেশি নগ্ন হয়ে পড়ছে। বৃহস্পতিবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করা হয়।

১৯৮০ থেকে শুরু করে দুই দশক ধরে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা তাড়ানোর প্রক্রিয়ার অগ্রভাগে ছিল সৌদি আরব। আফগান মুজাহিদীনদের অর্থ-সম্পদের অন্যতম প্রধান যোগানদাতাও ছিল তারা।

এরপর আফগান গৃহযুদ্ধে জয়ী হয়ে তালেবান যখন ১৯৯৬ সালে কাবুলে সরকার গঠন করে, তখন মাত্র যে তিনটি দেশ তাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল, তাদের অন্যতম ছিল সৌদি আরব। প্রথম দুই বছর তালেবানের ওই সরকারের অর্থকড়ির যোগানও আসতো রিয়াদ থেকে।

কিন্তু সেই তালেবান যখন আবারও ক্ষমতায়, তখন কাবুলে সৌদি দূতাবাস বন্ধ। রিয়াদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই প্যারার দায়সারা এক বিবৃতির বাইরে সৌদি সরকারের কাছ থেকে আফগান পরিস্থিতি নিয়ে কোনও কথা নেই।

লন্ডনে মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টের প্রধান সামি হামদী বলেন, ‘আফগান দৃশ্যপট থেকে সৌদি আরব উধাও।’

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্বের এবং এমনকি মুসলিম দুনিয়ায় সৌদি আরবের প্রভাব যে কমছে এটি তারই একটি জলজ্যান্ত নমুনা।’

সামি হামদী বলেন, ‘ক্ষুদ্র প্রতিবেশী কাতার আফগানিস্তানে মুখ্য একটি ভূমিকায়। তারা কাবুল বিমানবন্দরকে সচল করছে। এক সময়কার সৌদিদের ঘনিষ্ঠ মিত্র পাকিস্তানের সাথে আফগানিস্তান নিয়ে কথা বলছে কাতার। এমনকি ইউএই অস্বস্তিতে পড়লেও বসে নেই। আফগান পরিস্থিতি নিয়ে তারা কথা বলছে সৌদিদের প্রতিদ্বন্দ্বী তুরস্কের সাথে। অথচ সৌদি আরব কোথাও নেই।’

সৌদিরা যে এ নিয়ে হতাশ, তার কিছুটা প্রতিফলন দেখা গেছে অন্যতম শীর্ষ সৌদি দৈনিক ওকাযের বুধবারের সংস্করণে। জেদ্দা থেকে প্রকাশিত এই সংবাদপত্রের এক উপ-সম্পাদকীয়তে আফগানিস্তানে কাতারের ভূমিকায় যুক্তরাষ্ট্রের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে।

ওই উপ-সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র এখন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ছোটো ছোটো দেশের ওপর নির্ভর করছে, কিন্তু তারা এটা বুঝতে পারছে না যে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করতে সক্ষম শুধুই সৌদি আরব।’

কাতার নিয়ে সৌদিদের মাথাব্যথা কেন? গত প্রায় তিন বছর ধরে দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তালেবানের যে দর কষাকষি চলেছে, তাতে মধ্যস্থতা করেছে কাতার। তালেবান কাবুল দখলের পর বিদেশীদের নিরাপদে আফগানিস্তান থেকে বের করে আনার ব্যাপারেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন প্রশাসন তাতে এতটাই সন্তুষ্ট যে গত ৬ই সেপ্টেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এক সাথে দোহায় গিয়ে কাতারের ৪১ বছর বয়স্ক আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সাথে ডিনার করেন। পরে ব্লিনকেন বলেন, ‘কাতার এবং যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সম্পর্ক অভূতপূর্ব।’

অথচ ২০১৭ সালের জুন মাস থেকে সাড়ে তিন বছর ধরে এই কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ করে রেখেছিল সৌদি আরব।

সৌদির তালেবান সঙ্কট: সম্পর্কে ভাঙনের শুরু যখন ১৯৯৮ সালে আল-কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেন গিয়ে আশ্রয় নেন আফগানিস্তানে। সৌদি আরব তাকে আটক করে তাদের হাতে তুলে দিতে বললে তা অগ্রাহ্য করে সে সময়কার তালেবান সরকার।

এরপর ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পর তালেবান-সৌদি সম্পর্ক হিমঘরে চলে যায়। তবে ২০০৮ সালে হঠাৎ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সৌদি আরবের সাথে তালেবানের যোগাযোগ তৈরি হওয়ার খবর বেরোতে শুরু করে।

ওই বছর অক্টোবরে রোজার মাসে সৌদি সরকারের মালিকানাধীন দৈনিক আশরাক আল আসওয়াতের এক খবরে বলা হয়, মক্কা শহরে আফগান সরকারের সাথে এক প্রতিনিধিদলের সাথে তালেবানের কয়েকজন নেতার একটি বৈঠক হয়েছে।

তালেবানের ওই দলে ছিলেন গোষ্ঠীটির প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের মুখ্য সচিব তাইয়েব আগা, যিনি পরে দোহায় তালেবানের রাজনৈতিক অফিসের প্রধান হয়েছিলেন।

তৎকালীন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সউদ আল ফয়সল সাংবাদিকদের কাছে বৈঠকটি হওয়ার কথা স্বীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের অনুরোধে সৌদি সরকার ওই বৈঠকের ব্যবস্থা করেছে।

লন্ডনে আফগান সাংবাদিক ও বিশ্লেষক সাইয়েদ আব্দুল্লাহ নিজামী জানান, বারাক ওবামা ক্ষমতায় আসার পর ২০০৮ সাল থেকেই গোপনে তালেবানের সাথে যোগাযোগ শুরু হয় এবং মক্কার বৈঠকটি ছিল তারই অংশ।

‘কাতার-যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সম্পর্ক অভূতপূর্ব,’ সেপ্টেম্বরে জানান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন

সাইয়েদ আব্দুল্লাহ নিজামী বলেন, ‘একাধিক তালেবান নেতা আমাকে বলেছেন যে, প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল জার্মানিতে, তারপর নরওয়েতে। কিন্তু শর্ত নিয়ে নানা বাদানুবাদে অগ্রগতি ছিল খুবই মন্থর।’

নিউইয়র্ক টাইমস-সহ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক গণমাধ্যমেও সে সময় গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে তালেবানের সাথে গোপন যোগাযোগের খবরাখবর বেরিয়েছে। তবে সে সময়েই সৌদিদের সাথে তালেবানের সম্পর্কে আবারও চিড় ধরে। এর কারণ ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনায় সৌদি আরবের মধ্যস্থতায় তালেবান রাজী না হয়ে কাতারের প্রস্তাবে তারা সায় দেয়।

সাইয়েদ আব্দুল্লাহ নিজামী বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট কারজাইয়ের সাথে সৌদিদের দহরম-মহরম দেখে ভরসা পায়নি তালেবান। কিন্তু মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাতারকে বেছে নেয়ার তালেবানের সিদ্ধান্ত সৌদিরা পছন্দ করেনি।’

২০০৯ সালে খবর বের হয় যে সৌদি আরব তালেবান নেতা তাইয়েব আগাকে সে দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে। এরপর ২০১৩ সালে কাতারের রাজধানী দোহায় প্রতিষ্ঠিত হয় তালেবানের রাজনৈতিক অফিস। সেখানে বসেই যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান সরকারের সাথে চলে আপোষ মীমাংসা।

বর্তমানে তালেবানের ওপর সৌদিদের কোন প্রভাব নেই বললেই চলে। অথচ গত কয়েক বছরে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু ইরানের সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তালেবানের।

তালেবান যে আবার এককভাবে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করবে, তা হয়তো স্বপ্নেও ভাবেনি সৌদি আরব। সে কারণেই হয়তো ২০১৯ সালে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের পাকিস্তান সফরের সময় তালেবানের একটি প্রতিনিধিদল তার সাথে দেখা করতে চাইলে তিনি পাত্তা দেননি।

অবশ্য সে সময় বিভিন্ন মিডিয়ায় খবর বের হয়েছিল যে নিজেদের ইচ্ছায় নয়, বরং পাকিস্তানের ইচ্ছাতেই তালেবানের কয়েক জন নেতা দোহা থেকে ইসলামাবাদ গিয়েছিলেন।

তোপের মুখে সৌদি-পন্থী আফগান ওয়াহাবীরা: গত মাসের মাঝামাঝি কাবুল দখলের পর সৌদি সমর্থিত হিসাবে পরিচিত বেশ ক'জন ওয়াহাবী নেতাকে তালেবান আটক করেছে বলে খবর বেরিয়েছে। সাইয়েদ আব্দুল্লাহ নিজামী বলেন, ‘সৌদি সাহায্যে চলা ওয়াহাবী মাদ্রাসা এবং প্রতিষ্ঠানগুলো ভয়ে রয়েছে। কাবুলে একজন ওয়াহাবী-পন্থী মোল্লা খুন হয়েছেন এবং অভিযোগের তীর তালেবানের দিকে, যদিও তারা তা অস্বীকার করেছে।’

কিন্তু কেন ওয়াহাবী-পন্থী নেতাদের টার্গেট করছে তালেবান? - এই প্রশ্নে নিজামী দুটো কারণের কথা উল্লেখ করেন।

প্রথমত, ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠী এখন আফগানিস্তানে তালেবানের প্রধান প্রতিপক্ষ এবং তারা, মানে ওয়াহাবীরা ইসলামিক স্টেটকে সমর্থন করে। দ্বিতীয়ত, দেওবন্দী ছাড়া অন্য কোন সুন্নী মতবাদ আফগানিস্তানে জায়গা পাক, তালেবান তা চায় না।

বাংলাদেশ জার্নাল / টিটি

  • সর্বশেষ
  • পঠিত