ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৮ মিনিট আগে
শিরোনাম

জাতিসংঘের জলবায়ু প্রতিবেদন বদলানোর চেষ্টায় যেসব দেশ

  আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০২১, ১৬:৫৩  
আপডেট :
 ২২ অক্টোবর ২০২১, ১৮:৩৭

জাতিসংঘের জলবায়ু প্রতিবেদন বদলানোর চেষ্টায় যেসব দেশ
বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য গ্রিনহাউজ গ্যাসকে দায়ী করা হয়। ছবি: বিবিসি

জাতিসংঘ তাদের যে প্রতিবেদনে সারা বিশ্বে কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার উপর জোর দিচ্ছে, ফাঁস হয়ে যাওয়া কিছু কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছে যে, কয়েকটি দেশ আন্তর্জাতিক সংস্থাটির গুরুত্বপূর্ণ এ বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদন বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

বিবিসির হাতে আসা এসব কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছে- সৌদি আরব, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের মতো কিছু দেশ জাতিসংঘকে বলছে যে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে দ্রুত সরে আসার প্রয়োজনীয়তাকে কম গুরুত্ব দিয়ে দেখাতে।

জীবাশ্ম জ্বালানি গ্রিনহাউজ গ্যাসের প্রধান উৎস এবং বিজ্ঞানীরা বলছেন, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঠেকাতে এসব জ্বালানির ব্যবহারের লাগাম টেনে ধরা খুবই জরুরি।

আগামী নভেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠেয় জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের কপ-২৬ সম্মেলনের আগে এ সংক্রান্ত অনেক কাগজপত্র ফাঁস হয়ে গেছে, যা বিবিসির হাতে এসে পৌঁছেছে।

বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা যাতে শিল্পযুগের আগের সময়ের তাপমাত্রার তুলনায় দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে না পারে, সেজন্য কপ-২৬ সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কর্মসূচি গ্রহণের কথা রয়েছে।

তার ঠিক কয়েকদিন আগে এসব নথিপত্র ফাঁস হয়ে গেল, যাতে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন দেশ জাতিসংঘের উপর চাপ দেওয়ার চেষ্টা করছে যাতে সংস্থাটি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাপারে এখনই কঠোর অবস্থান গ্রহণ না করে।

বিবিসি দেখতে পেয়েছে, বিজ্ঞানীদের যে দলটি জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলার উপায় খুঁজে বের করার জন্য জাতিসংঘের এ প্রতিবেদনটি তৈরি করছে, তাদের কাছে বিভিন্ন দেশের সরকার, কোম্পানি এবং সংশ্লিষ্ট আরও কিছু পক্ষ তাদের যুক্তি তুলে ধরে ৩২ হাজারের বেশি প্রস্তাব পেশ করেছে।

জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের আন্তঃসরকার কমিটি বা আইপিসিসি প্রত্যেক ছয়/সাত বছরে এ রকম একটি প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে, যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বিষয় মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করা হয়।

এসব প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।

আসন্ন গ্লাসগো সম্মেলনে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে দরকষাকষির আলোচনায় জাতিসংঘের সবশেষ এ প্রতিবেদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জাতিসংঘ আশা করছে, এসব প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের সব দেশের সরকার সমঝোতায় পৌঁছানোর প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবে।

নরওয়ের একটি গ্যাসক্ষেত্রে কার্বন নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে ১৯৯৬ সাল থেকে

বিজ্ঞানীদের কাছে বিভিন্ন দেশের সরকারের করা মন্তব্য এবং প্রতিবেদনের সর্বশেষ খসড়া পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিস ইউকে-র একদল অনুসন্ধানী সাংবাদিকের মাধ্যমে বিবিসির হাতে এসে পৌঁছে।

ফাঁস হয়ে যাওয়া এসব কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছু দেশ এবং সংস্থা যুক্তি দিচ্ছে যে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে যতো দ্রুত গতিতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে, আসলে তার কোন প্রয়োজন নেই।

সৌদি আরবের তেল মন্ত্রণালয়ের একজন উপদেষ্টা দাবি করেছেন, ‘প্রতিবেদন থেকে ‘সর্বস্তরে জরুরি-ভিত্তিতে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন’- এ ধরনের কথা বাদ দিতে হবে।’

‘কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন’- খসড়া প্রতিবেদনের এ ধরনের উপসংহার প্রত্যাখ্যান করেছেন অস্ট্রেলিয়ার সরকারের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, যদিও গ্লাসগো সম্মেলনের অন্যতম প্রধান একটি লক্ষ্য কয়লা ব্যবহারের অবসান ঘটানো।

সৌদি আরব বিশ্বের বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর একটি এবং অস্ট্রেলিয়াও অন্যতম বৃহৎ কয়লা রপ্তানিকারক দেশ।

ভারতে জ্বালানি সংক্রান্ত একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট অফ মাইনিং অ্যান্ড ফুয়েল রিসার্চ- যার সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে- তার একজন শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আরও কয়েক দশক কয়লার ওপর নির্ভর করতে হবে।

জ্বালানির জন্য ভারত কয়লার ওপর নির্ভরশীল

কারণ, সবার কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া ভারতের জন্য এখনও ‘কঠিন চ্যালেঞ্জ’ বলে মনে করে এই প্রতিষ্ঠান। কয়লার ব্যবহারের হিসেবে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ।

বেশ কয়েকটি দেশ বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে সেটি ভূগর্ভে স্থায়ীভাবে মজুদ করে রাখার অত্যাধুনিক ও ব্যয়বহুল প্রযুক্তি ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছে। এ প্রযুক্তি কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ বা সিসিএস নামে পরিচিত।

জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহারের হিসেবে বিশ্বের বৃহৎ কয়েকটি দেশ- সৌদি আরব, চীন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেক- বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন শুষে নিয়ে মজুদ করে রাখার পক্ষে।

দাবি করা হচ্ছে যে, এই সিসিএস প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কারখানায় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গত কার্বনের পরিমাণ নাটকীয়ভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব।

বিশ্বের বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক দেশ সৌদি আরব জাতিসংঘের বিজ্ঞানীদেরকে প্রতিবেদনটির কিছু উপসংহার বাদ দেওয়ার অনুরোধ করেছে। ওই উপসংহারে বলা হয়েছে, ‘জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ধাপে ধাপে কমিয়ে জ্বালানি উৎপাদনের জন্য দ্রুত জিরো-কার্বন (যেখানে কার্বন নির্গত হয় না) উৎসের কাছে যেতে হবে।’

আর্জেন্টিনা, নরওয়ে এবং ওপেকের মন্তব্যও একই ধরনের। নরওয়ে বলছে, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কার্বন নির্গমন কমাতে সিসিএস প্রযুক্তির সম্ভাবনাকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে জাতিসংঘের বিজ্ঞানীদের।

খসড়া প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছে যে, ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তি কিছু ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এর বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।

ওপেকের করা মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে এই জোট বিবিসিকে বলেছে, ‘কার্বন নির্গমন মোকাবেলায় বহু উপায় রয়েছে, আইপিসিসির প্রতিবেদনেও এসবের উল্লেখ রয়েছে। এর সবকটিই আমাদের পরীক্ষা করে দেখতে হবে। আমাদেরকে যেমন সব জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে, তেমনি নির্গমন কমাতে আরও দক্ষ ও দূষণ-মুক্ত প্রযুক্তিগত সমাধানও খুঁজে বের করতে হবে।’

জাতিসংঘের খসড়া প্রতিবেদনে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন ঠেকাতে মাংস খাওয়ার পরিমাণ কমানোর যে সুপারিশ করা হয়েছে, গোমাংস উৎপাদনে বিশ্বের দুটো বৃহত্তম দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা তার বিরোধিতা করেছে।

খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘উদ্ভিদভিত্তিক ডায়েট বা খাবারদাবার পশ্চিমা ডায়েটের তুলনায় গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে।’ কিন্তু ব্রাজিল বলছে, এই তথ্য সঠিক নয়।

এ দুটো দেশই প্রতিবেদন থেকে এ সংক্রান্ত কিছু পরিচ্ছদ বাদ দেওয়া বা পরিবর্তন করার জন্য বিজ্ঞানীদের প্রতি আহবান জানিয়েছে। বিশেষ করে যেসব স্থানে ‘উদ্ভিদ-ভিত্তিক ডায়েট’ এবং মাংসকে ‘বড় ধরনের কার্বন’ খাবার বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনের যেসব জায়গায় রেডমিট বা লাল মাংসের ওপর কর আরোপ এবং ‘মাংস-বিহীন সোমবার’ (সপ্তাহের একটি দিনে মাংস পরিহার করা) এ ধরনের প্রচারণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো রিপোর্ট থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলেছে আর্জেন্টিনা।

কার্বন নির্গমন কমাতে মাংস খাওয়া কমানোর ওপর জোর দিচ্ছেন জাতিসংঘের বিজ্ঞানীরা

দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটি ‘মাংস-ভিত্তিক ডায়েটের প্রভাবের বিষয়ে ঢালাও মন্তব্য পরিহার’ করতে সুপারিশ করেছে। তারা বলছে, মাংস-ভিত্তিক ডায়েট যে কার্বন নির্গমন কমাতে পারে, তার পক্ষেও তথ্যপ্রমাণ রয়েছে।

একই বিষয়ে ব্রাজিলও বলছে, ‘উদ্ভিদ-ভিত্তিক ডায়েট যে কার্বন নির্গমন কমায় কিম্বা নিয়ন্ত্রণ করে তার কোন গ্যারান্টি নেই।’ তারা বলছে, খাবারের ধরন নিয়ে বিতর্ক না করে উৎপাদনের প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলা উচিত।

আমাজনসহ আরও কিছু অরণ্যে বন ধ্বংসের ব্যাপারে সরকারি নীতি পরিবর্তনকে দায়ী করার অভিযোগও ব্রাজিল প্রত্যাখ্যান করেছে।

পরমাণু বিদ্যুৎ: বেশ কিছু দেশ, যাদের বেশিরভাগই পূর্ব ইউরোপের, তারা জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে পরমাণু বিদ্যুতকে আরও ইতিবাচকভাবে প্রতিবেদনে তুলে ধরার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহবান জানিয়েছে।

ভারত আরও এক ধাপ এগিয়ে বলছে, ‘প্রতিবেদনের প্রায় সব অধ্যায়ে পরমাণু শক্তির বিরুদ্ধে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে।’ ভারতের যুক্তি, ‘এটি একটি প্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তি যার পেছনে, গুটিকয়েক দেশ ছাড়া, ভাল রকমের রাজনৈতিক সমর্থন রয়েছে।’

চেক রিপাবলিক, পোল্যান্ড এবং স্লোভাকিয়া প্রতিবেদনের একটি টেবিলের সমালোচনা করেছে। ওই টেবিলে দেখানো হয়েছে, জাতিসংঘের ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে মাত্র একটি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে পরমাণু বিদ্যুতের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। তারা বলছে, জাতিসংঘের সব উন্নয়ন কর্মসূচিতে পরমাণু শক্তি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর জাতিসংঘের আইপিসিসি কয়েক বছর পর পর বৈজ্ঞানিক রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে

জাতিসংঘের বক্তব্য: বিভিন্ন দেশের সরকার ও সংস্থার এসব মন্তব্যের ব্যাপারে জাতিসংঘের বিজ্ঞানীদের দল আইপিসিসি বলছে, তাদের বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা প্রক্রিয়ায় এসব মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রতিবেদনে এসব অন্তর্ভুক্ত করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই।

আইপিসিসির পক্ষ থেকে বিবিসিকে বলা হয়, ‘আমাদের পর্যালোচনার প্রক্রিয়া এমনভাবে করা হয়, যাতে কেউ প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। এ প্রক্রিয়া আইপিসিসির কাজের ভিত্তি এবং আমাদের প্রতিবেদনের শক্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রধান উৎস।’

আইপিসিসির বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাদের প্রতিবেদনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তারা বলছেন, বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানির পক্ষ থেকে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে, তারা শুধু সেগুলোর বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোই বিবেচনা করে থাকেন।

আইপিসিসির বিজ্ঞানী প্রফেসর করিন লে কেরি বলেন, ‘এসব মন্তব্য গ্রহণ করার জন্য বিজ্ঞানীদের ওপর কোন চাপ নেই। প্রভাব বিস্তারের জন্য মন্তব্য করা হলেও, তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকলে সেগুলো রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করার কোন সুযোগ নেই।’

জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলায় আইপিসিসির কাজের জন্য জাতিসংঘকে ২০০৭ সালে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়েছিল।

বাংলাদেশ জার্নাল/ টিটি

  • সর্বশেষ
  • পঠিত