ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৮ মিনিট আগে
শিরোনাম

হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র: নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতায় বিশ্ব?

  আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২১, ১৩:২৮

হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র: নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতায় বিশ্ব?
চীন তার হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র গ্লাইড যানবহর প্রদর্শন করে ২০১৯-এ বেইজিং কুচকাওয়াজে। ছবি: বিবিসি

চীন সম্প্রতি পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্রের যে পরীক্ষা চালিয়েছে, সেই খবরকে অনেকে বর্ণনা করেছেন মোড় বদলানো একটা ঘটনা হিসাবে। সোমবার প্রকাশিত বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, এ পরীক্ষার খবর যুক্তরাষ্ট্রকে চমকে দিয়েছে।

এটা আসলেই কতটা চমকে দেবার মত ঘটনা, ব্যাখ্যা করেছেন ব্রিটেনে এক্সিটার ইউনিভার্সিটির স্ট্রাটেজি ও সিকিউরিটি ইনস্টিটিউটের জনাথান মার্কাস।

গ্রীষ্মকালে, চীনা সামরিক বাহিনী দুই বার মহাকাশে রকেট উৎক্ষেপণ করে, যে রকেট পৃথিবী পরিক্রমা করার পর তার লক্ষ্যবস্তুর দিকে দ্রুতগতিতে ছুটে যায়।

প্রথমবার সেটি লক্ষ্যবস্তুর প্রায় ২৪ মাইল দূর দিয়ে চলে যায়, ফলে নিশানায় আঘাত করতে ব্যর্থ হয়। গোয়েন্দা তথ্য বিষয়ক এক ব্রিফিং থেকে যারা এ তথ্য জানতে পারেন, তাদের সাথে কথা বলে প্রথম এ খবর প্রকাশ করে লন্ডন থেকে প্রকাশিত অর্থনীতি বিষয়ক প্রভাবশালী সংবাদপত্র ফাইনানশিয়াল টাইমস।

যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনীতিক এবং ভাষ্যকার চীনের কার্যত এই উন্নতিতে শঙ্কা প্রকাশ করেন। বেইজিং অবশ্য তড়িঘড়ি এই রিপোর্ট নাকচ করে দিয়ে বেশ জোরের সঙ্গে জানায়, তারা আসলে পুনর্ব্যবহারযোগ্য একটি মহাকাশ যান পরীক্ষা করছিল।

ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরেতে মিডলবেরি ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশানাল স্টাডিসে পূর্ব এশিয়ায় অস্ত্র বিস্তার রোধ বিষয়ক গবেষণার পরিচালক জেফ্রি লিউইস চীনের এ অস্বীকৃতিকে তাদের বিষয়টি ‘ঘোলাটে করার প্রয়াস’ হিসাবে দেখছেন। কারণ, তিনি বলছেন, অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে মার্কিন কর্মকর্তারাও এই পরীক্ষার কথা নিশ্চিত করেছেন।

তিনি মনে করছেন, মহাকাশ কক্ষপথে এ ধরনের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চীন পরীক্ষা চালিয়েছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, সেটা ‘কারিগরি সক্ষমতার দিক থেকে এবং কৌশলগত কারণে’ চীনের পক্ষে করা খুবই সম্ভব।

আইসিবিএম আর ফবস কী? আইসিবিএম বা ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল একটি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে বেরিয়ে ছুটতে পারে, আবার পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে। এই ক্ষেপণাস্ত্র অধিবৃত্তাকার গতিপথ ধরে নিশানার দিকে ছোটে। ফবস বা ফ্র্যাকশনাল অরবিটাল বোম্বার্ডমেন্ট সিস্টেম পদ্ধতিতে ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানো হয় আংশিকভাবে পৃথিবীর কক্ষপথে যাতে অপ্রত্যাশিত কোন স্থান থেকে তা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।

ফিলাডেলফিয়ায় ফরেন পলিসি ইন্সটিটিউটের গবেষণা পরিচালক অ্যারন স্টেইন বলেন, ‘ফাইনানশিয়াল টাইমসের খবর এবং চীনের অস্বীকৃতি দুটোই সত্য হতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘পুনর্ব্যবহারযোগ্য একটি মহাকাশযানও একটি হাইপারসোনিক গ্লাইডার। গ্লাইডার জাতীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে ফবস ব্যবহার করলে সেটা একটা পুনর্ব্যবহারযোগ্য মহাকাশযানের মতই কাজ করবে। কাজেই দুটি বক্তব্যের মধ্যে যে পার্থক্য আছে তা খুবই নগণ্য।’

আসলে সাম্প্রতিক কয়েকমাস ধরে বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তাও এমন ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন যে চীন এই প্রযুক্তিতে অনেক উন্নতি করেছে।

ফবস আসলে নতুন কোন প্রযুক্তি নয়। শীতল যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এ প্রযুক্তির ধারণা নিয়ে কাজ করেছিল। চীন এখন মনে হচ্ছে সেই প্রযুক্তি নিয়ে এগোনোর কাজটি পুনরুদ্ধার করছে। এ পদ্ধতিতে ছোঁড়া অস্ত্র পৃথিবীর কক্ষপথে আংশিকভাবে ঢোকে। ফলে কোন্ দিক থেকে সেটা লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করবে সেটা আন্দাজ করা সম্ভব হয় না।

ধারণা করা হচ্ছে, চীন এখন যেটা করেছে সেটা হল, ফবস প্রযুক্তিকে হাইপারসোনিক গ্লাইডারের সাথে সংযুক্ত করে নতুন এক প্রযুক্তি তৈরি করেছে। এ প্রযুক্তিতে ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গা ঘেঁষে চলে, যে কারণে কোন রাডারে তা ধরা পড়ে না বা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থায় সেটাকে ধ্বংস করাও সম্ভব হয় না।

কিন্তু চীনের লক্ষ্য কী? লিউইস বলেন, ‘বেইজিং-এর আশঙ্কা চীনের পরমাণু প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের আধুনিক পারমাণবিক অস্ত্র এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা সমন্বিত ভাবে ব্যবহার করবে।’

অ্যারন স্টেইন বলছেন, পরমাণু শক্তিধর বড় দেশগুলোর বেশিরভাগই এখন হাইপারসোনিক মিসাইল ব্যবস্থা গড়ে তুলছে। তবে এই প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে তফাৎ রয়েছে।

তার যুক্তি, দৃষ্টিভঙ্গির এ তফাৎই এক দেশকে আরেক দেশের অভিপ্রায় নিয়ে অতিমাত্রায় সন্দিগ্ধ করে তুলছে এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতায় মূল ইন্ধন যোগাচ্ছে।

অ্যারন স্টেইনের বিশ্বাস, চীন এবং রাশিয়া মনে করে হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র, মিসাইল প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে পরাজিত করার নিশ্চিত একটা প্রযুক্তি। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চায়; তাদের বিবেচনায় সেইসব লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করতে, যেগুলো পারমাণবিক অস্ত্রের কমান্ড এবং নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়।

চীনের ‘স্পুটনিক মুহূর্ত’: যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু শক্তির দ্রুত আধুনিকায়নকে যারা সমর্থন করেন, তারা চীনের এ সাম্প্রতিক পরীক্ষাকে দেশটির ‘স্পুটনিক মুহূর্ত’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। ১৯৫০-এর শেষ দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন মহাকাশের কক্ষপথে সফলভাবে তাদের উপগ্রহ পাঠায়, তখন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত সাফল্যে এ ধরনের বিস্ময় ও শঙ্কা প্রকাশ করেছিল।

রাশিয়ার তৈরি গ্লাইডিং প্রযুক্তি দিয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন আভানগার্ড হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র

তবে অনেক বিশেষজ্ঞ তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। তারা মনে করেন না যে চীনের এ সাম্প্রতিক পরীক্ষা নতুন করে কোন হুমকি সৃষ্টি করেছে। কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশানাল পিস-এর জেমস অ্যাকটন বলছেন, অন্তত ১৯৮০-র দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে তারা চীনের দিক থেকে পারমাণবিক হামলার হুমকিতে রয়েছে।

তবে তিনি মনে করেন, চীন, রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে পরাস্ত করতে যেভাবে উঠে পড়ে এগোচ্ছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র এখন দেখতে চাইবে এ ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সীমিত রাখতে বিধিনিষেধ আরোপ করে যেসব চুক্তি রয়েছে, সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে কাজ করবে কিনা।

ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরেতে মিডলবেরি ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশানাল স্টাডিসে পূর্ব এশিয়ায় অস্ত্র বিস্তার রোধ বিষয়ক গবেষণার পরিচালক জেফ্রি লিউইস জোর দিচ্ছেন যে, এখানে যুক্তরাষ্ট্রকে ঝুঁকিটা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে।

জেফ্রি লিউইস বলেন, ‘আমার আশঙ্কা বিষয়টা নাইন-ইলেভেনের মত না হয়ে দাঁড়ায়! ১১ই সেপ্টেম্বরের হামলার পর দিশেহারা হয়ে আবার হামলার ঝুঁকি ও আশঙ্কা থেকে আমরা পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একের পর এক বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যা আমাদের নিরাপত্তাকে আরও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বস্তুত আমরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি তার একটা হল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রবিরোধী চুক্তি- এবিএম চুক্তি থেকে আমরা সরে এসেছি। চীনের এ হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে এগোনোর পেছনে অন্য যে কারণই থাক না কেন- সবচেয়ে বড় কারণ হল এটাই।’

যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সবগুলো বৈরি দেশই তাদের পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডার আধুনিক এবং আরও সমৃদ্ধ করছে।

চীনের অস্ত্র সম্ভার যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় নগণ্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা আর দূর পাল্লার লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে আঘাত করার প্রযুক্তি নিয়ে উদ্বেগ থেকেই চীন তাদের পরমাণু অস্ত্রের ভাণ্ডার আরও উন্নত, আরও শক্তিশালী করছে।

উত্তর কোরিয়াও বসে নেই। তারাও তাদের পরমাণু সক্ষমতা বাড়াচ্ছে এবং আধুনিক অস্ত্র তৈরি করছে।

পুতিন ও তার প্রতিরক্ষা প্রধানরা ২০১৮ সালে ভিডিও লিংকের মাধ্যমে হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ দেখছেন

কার্নেগি এনডাওমেন্টের অঙ্কিত পান্ডা বলছেন, সাম্প্রতিক কয়েক বছরে উত্তর কোরিয়া তাদের যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হিসাবে দাবি করে চলেছে। তারা মনে করছে রাষ্ট্র হিসাবে মর্যাদা বাড়াতে এবং সম্মান অর্জন করতে অত্যাধুনিক পারমাণবিক অস্ত্র এবং শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করার বিকল্প নেই।

পারমাণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার এই প্রতিযোগিতা বাইডেন প্রশাসনের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। শীতল যুদ্ধের সময় থেকে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের যেসব চুক্তি উত্তরাধিকার সূত্রে চলে আসছে, তার অনেকগুলোই আর সময়োপযোগী নয়। মস্কো আর বেইজিংএর সাথে সম্পর্কে টানাপোড়েনও অস্বস্তির একটা বড় কারণ।

পান্ডা মনে করেন, অস্ত্র ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার এই দৌড়, অস্ত্র তৈরির এ প্রতিযোগিতা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অর্থবহ একটা পথ হবে ‘ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে যাওয়া।’

তিনি মনে করেন, ‘একমাত্র আলোচনার মধ্যে দিয়ে রাশিয়া আর চীনের সঙ্গে একটা অর্থবহ চুক্তি বা সমঝোতায় পৌঁছন সম্ভব। আলোচনার মধ্যে দিয়ে কোন ছাড় আদায় করতে পারলে তবেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ব্যয়বহুল ও বিপজ্জনক এই দৌঁড়ে রাশ টানা সম্ভব।’ জনাথান মার্কাস ব্রিটেনের এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটি ইন্সটিটিউটের সাম্মানিক অধ্যাপক।

বাংলাদেশ জার্নাল/ টিটি

  • সর্বশেষ
  • পঠিত