ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

বিরহী প্রেমের ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন

  মনোরমা স্মৃতি

প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২২, ১৭:০০  
আপডেট :
 ০২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৪:২৬

বিরহী প্রেমের ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন

পৃথিবীতে একজন মানুষের কাছে সবচেয়ে দামী তার জীবন। কাউকে যদি বলা হয় পৃথিবীর সব কিছু একদিকে অন্যদিকে তোমার জীবন। তুমি কোনটা চাও? বেছে নিতে বললে মানুষ কোনটা বেছে নেবে তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে এই জীবনের চেয়েও দামী হয়ে ওঠে ভালোবাসা বা ভালোবাসার মানুষটা। আর এই বিরল প্রেম সবার কপালে জোটেনা।

লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ আর মমতাজের প্রতি সম্রাট শাহজাহানের অমর প্রেমকাহিনীর মতো পৃথিবীতে ভালবাসাবাসি মানুষদের বিয়োগান্তক ঘটনা রয়েছে। যা এখনো প্রজন্মের কাছে কালের সাক্ষী। যদিও মমতাজের প্রতি সম্রাট শাহজাহানের ভালোবাসা নিয়ে অনেক দ্বিমত রয়েছে। নাইবা গেলাম সে বিতর্কে।

তেমনি এক বিরল অমর প্রেমগাঁথা “মাথিনের কূপ” যে কূপটির অবস্থান দেশের সর্ব দক্ষিণের সীমান্ত জেলা কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা থানা কম্পাউন্ডে।

পাসপোর্ট বানিয়ে, ভিসা লাগিয়ে প্রচুর অর্থ ও সময় ব্যয় করে এবং যথেষ্ট কষ্ট করে মানুষ দূর-দূরান্তের সৌন্দর্য দেখতে ছুটে যান। কিন্তু ঘরের কাছে অনির্বচনীয় সৌন্দর্যটুকু দেখা হয় না বলে সে দেখা পূর্ণতা পায়না।

এমন প্রেক্ষাপটে মনে পরে রবী ঠাকুরের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন-

দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা

দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু

দেখা হয়নাই চক্ষু মেলিয়া

ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া

একটি ধানের শীষের উপরে একটি শিশির বিন্দু।

এক অমর প্রেমের বেদনাবিধুর কাহিনীর ইতিহাস জানতে যেতে পারেন কক্সবাজারের টেকনাফে মাথিনের কূপ। নাফ নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এ উপজেলায় অবস্থিত ঐতিহাসিক মাথিনের কূপ। প্রেম প্রেয়সীদের জন্য অনন্য এক নিদর্শন এই মাথিনের কূপ। এ প্রেম এমনই প্রগাঢ় ছিলযে, মাথিন ভালোবাসার মানুষকে না পেয়ে অনিদ্রা আর অনাহারে নিজের প্রাণকে উৎসর্গ করেছিলেন। রাখাইন জমিদার-কন্যা মাথিন তার নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে বুঝিয়ে গেছেন, প্রেম মানে নিবেদিত প্রাণের সাধনা।

বিংশ শতকের শুরুর দিকের ঘটনা। কলকাতা থেকে ধীরাজ ভট্টাচার্য নামে সুদর্শন এক পুলিশকর্মকর্তা বদলি হয়ে আসেন টেকনাফ থানায়। তৎকালীন সময়ে এলাকাটি অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ নানা কারণে অনেকটা দুর্গম ও ভয়ংকর জায়গা হিসেবে পরিচিত ছিল। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা টেকনাফ থানার অদূরে সমুদ্রের নীল জলরাশি সে এক অনবদ্য প্রাকৃতিক মুগ্ধতা। থানায় ধীরাজ ভট্টাচার্যের খুব একটা বেশি কাজের চাপছিলনা। বেশিরভাগ সময়ই এখানে-সেখানে ঘুরেফিরেই কাটাতেন। থাকতেন থানার আধাপাকা ঘরের একটি কক্ষে।

একদিন একাধিক নারীকণ্ঠের অস্পষ্ট মৃদু গুঞ্জনে ধীরাজের ঘুম ভেঙে যায়। থানার ছোটবারান্দায় এসে ধীরাজ দেখলেন রং-বেরঙের ফতুয়া পরিহিতা ৫০/৬০ জন মগ রাখাইন তরুণী পাতকুয়ার চারদিকে জড়ো হয়ে হাসি গল্পে মশগুল। তাদের সুউচ্চ কলহাস্যে থানা প্রাঙ্গণ মুখরিত। এটাই ছিল সমগ্র টেকনাফে একটি মাত্র কুয়া। প্রতিদিন তরুণীরা পাতকুয়ায় জল নিতে আসতেন। আর ধীরাজ থানার বারান্দায় চেয়ারে বসে তরুণীদের জল তোলার দৃশ্য দেখতেন।

একদিন ধীরাজের নজরে পড়ে সম্পূর্ণ নতুন সাজে সজ্জিত আরেক তরুণীকে, সুন্দরী এই তরুণীর নাক-চোখ-মুখ বাঙালির মেয়েদের মতো। নাম তার মাথিন। টেকনাফের জমিদার ওয়ানথিনের একমাত্র মেয়ে। প্রথম দর্শনেই মেয়েটিকে তার ভালো লেগে যায়।

প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগেই ধীরাজ ভট্টাচার্য থানার বারান্দায় চেয়ারে গিয়ে বসে মাথিনের আগমনের প্রতীক্ষা করতেন। মাথিন যখন কলসি কাঁখে তার সুউচ্চ গ্রীবা দুলিয়ে থানা প্রাঙ্গণ দিয়ে হেঁটে আসতেন।

ধীরাজ তন্ময় হয়ে সেদৃশ্য উপভোগ করতেন। অন্যান্য তরুণী আসার আগেই মাথিন পাত কুয়ায় আসতেন এবং জল নিয়ে ফিরতেন। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশে তারা একে অপরের সঙ্গে গভীরপ্রেম ও মোহবেশে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন। দিন গড়াতে থাকে।

ইতোমধ্যে দুজনের প্রেমের কথা সবাই জেনে যায়। নানা বাধা সত্ত্বেও দুজনের মধ্যে বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়। এরই মধ্যে কলকাতা থেকে বাবার চিঠি আসে ধীরাজের কাছে। ধীরাজকে কলকাতা যেতে হবে একমাসের ছুটি নিয়ে। ছুটি না মিললে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে হলেও যেতে হবে। ধীরাজ সিদ্ধান্ত নেন কলকাতা যাবেন। সিদ্ধান্তের কথা মাথিনকে জানানো হলো। মাথিন রাজি হলেন না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে ধীরাজ এক সন্ধ্যায় টেকনাফ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। ধীরাজের এভাবে চলে যাওয়াকে প্রেমিকা মাথিন সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি।

মাথিনের মনে হলো, বাবার অসুখের কারণ দেখিয়ে ধীরাজ বরং বিয়ে করার ভয়েই পালিয়েছে। ধীরাজকে হারিয়ে মাথিন অন্ন-জল ত্যাগ করে হন শয্যাশায়ী। জমিদার বাবা ওয়ানথিনসহ পরিবারের সদস্যরা শত চেষ্টা করেও মাথিনকে অন্নজল ছোঁয়াতে পারেননি। তার এক কথা, ধীরাজকে চাই। প্রেমের এই বিচ্ছেদ এবং কষ্টে একদিন মাথিন মারা যান।

বিষাদের কষ্ট এবং বেদনা-বিধুর প্রেমের উপাখ্যানের বহুল আলোচিত সেই ঘটনার কালজয়ী সাক্ষী আজকের ঐতিহাসিক মাথিনের কূপ। যা এখনো আকর্ষণীয় হয়ে আছে সীমান্ত উপজেলার টেকনাফ থানা কম্পাউন্ডে। সেই থেকে পাতকুয়ার নামকরণ হয় অমর প্রেমের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক “মাথিনের কূপ”। প্রতিদিন কূপটি দেখার জন্য এখানে বহু পর্যটক ভিড়জমান।

বাংলাদেশ জার্নাল/এমএস

  • সর্বশেষ
  • পঠিত