ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৫৯ মিনিট আগে
শিরোনাম

কাকের পেটে পাকা বেল

  মোস্তফা কামাল পাশা

প্রকাশ : ০৪ মে ২০২১, ১৪:২৫

কাকের পেটে পাকা বেল
প্রতীকী ছবি

দাঁড় কাকটা ক্ষুধায় কাহিল। সারাদিন এর দরজায়, ওর রান্নাঘরের পেছনে অনেক ওড়াওড়ি করেছে। কা কা হল্লায় পাড়া কাঁপিয়েছে। কিন্তু মরা মুরগি বা মাছের কোন নাড়িভুঁড়ি পায়নি। নেই কোন ফেলে দেয়া পচা ডিমও। মানুষ জনের সাড়াও কম। বৈশাখের দুপুরে থম মেরে আছে পুরো পাড়া। এত মানুষ, কিন্তু বেশ ক’দিন থেকে কেমন যেন সব চুপচাপ। মানুষ বের হয় না, হাট-বাজারেও দল বেঁধে যায় না। দুয়েক জন বেরোয়। দোকানে সওদাপতিও করে চুপচাপ। তাও মুখে পট্টি বেঁধে। চায়ের দোকানে আড্ডাও নেই, টিভি’র শোর চিৎকারও নেই।

কী এক অবস্থা! চা’দোকান বা হোটেলের হেঁশেল থেকে আগে বাসি খাবার, মুরগির বাতিল হাড়গোড়, পাউরুটির টুকরো, পচা কলাসহ মানুষের ফেলে দেয়া টুক-টাক খাবার জুটত। খেত, বাসায় বাচ্চাদের জন্যও বাড়তি কিছু নিয়ে যেত। কিন্তু বেশ কিছুদিন থেকে খাবার কমে গেছে। মানুষগুলোও বদলে গেছে। সবখানে কেমন জানি, ভয়ের পাতলা কালো চাদর দুলছে। তার বাসায় দুটো বাচ্চা। না, কোকিলের নয়, তারই। কোকিল চেষ্টা করেছিল, নিজের কত না কষ্টের ডিম খেয়ে ওদের ডিম রেখে যেতে। কিন্তু কাক হলেও সে অতো বোকা না। কোকিলটাকে দাবড়ানি দিয়ে গ্রামছাড়া করেছে। তখন স্বামীও বাসার পাহারায় ছিল। বাচ্চা ফোটার পর ওই বেটা গায়েব। তাদের পুরুষ জাতটাই এমন! বাচ্চাগুলো এখনো উড়তে পারেনা। কিন্তু বড্ডো খিদে।

কাকটা খাবারের তালাশে ঘুরতে ঘুরতে রোদে কাহিল। অন্যদিন যাই হোক কিছু জুটতো, আজ কপাল খারাপ। উড়তে উড়তে ক্লান্ত পাখনাও আর দুলতে রাজি না। পাখা জোড়ার গোড়া ও মাঝের স্প্রিংএ বড্ডো ব্যাথাও। তাদের দোষ কী! খালি পেটের থলি সকাল থেকে একফোটাও শক্তি যোগান দিতে পারেনি! শেষে একটা আম ডালের ঝাঁকড়া পাতার ছায়ায় একটু বিশ্রাম নেয়। কাছেই বড়সড়ো এক বেলগাছ। পাতা নেই, ঝরে গেছে। ঝুম বৃষ্টি নামলে নতুন পাতার সবুজ কুঁড়ি গজাবে। গাছটার সবডালে অনেক বেল। বেলের ভারে নুয়ে পড়েছে ডালগুলো। কাঁচা পাকা মিলিয়ে অনেক। পাকা বেলের ম ম সুগন্ধে কাকটার পেটের খিদে মোচড় খায়। কিন্তু কথায় আছে না, ‘বেল পাকলে কাকের কী’! কোন মানুষ কবি বানিয়েছে কলিটা, কাক জাতিকে অপমান করতে। পেটের খিদেয় অস্থির দাঁড় কাকটার চোখ অপমানে একদম লাল হয়ে যায়। ওদিকে উপোসী বাচ্চাদের কষ্টের কথা মনে পড়তেই তার কলজে শুকিয়ে আমসি। ‘আহারে অবোধ বাছারা না, জানি কত কষ্ট পাচ্ছে’? হাজার হলেও মায়ের মন।

ঠোঁটজোড়া সমস্ত শক্তিতে চেপে ধরে মনে মনে শপথ নেয়, ‘মানুষের অপমানের চরম শোধ নেব আমি। আজ বেল দিয়েই দুপুরের লাঞ্চ করবো, বাচ্চাদেরও মজা করে খাওয়াবো! দারুণ মজার খাবার, সাথে কাক জাতির অপমানের কঠিন শোধও। কী পেয়েছিস মানুষ বেটারা! দুটো পা আছে বলে কাক জাতিকে ইচ্ছেমত অপমান করে যাবি! আর আমরা শত শত বছর তা হজম করে যাব, কভি নেহি! তোদের যেমন দুই পা, আমাদেরও দুই পা। বাড়তি আছে দুটো শক্তপোক্ত পাখনাও। তোরা হাজার মাথা কুটলেও এগুলো পাবি না কখনো।’

মনে মনে বুদ্ধি শানাতে থাকে সে। ‘আমার পূর্বপুরুষ বা রমণী পাথর কুঁচি ফেলে কলসের তলার পানি উপরে এনে তৃঞ্চা মিটায়। তাও মানুষের বয়ানি, আমাদের না। এবার আমি বেল খেয়ে আরেকটা রেকর্ড করবোই।

উপোষী দাঁড় কাকের কঠিন শপথ। দু’মিনিট ঝিম ধরে বসে বুদ্ধি বের করে ফেলে। এক উড়ালে বেল গাছের একটা ডালে বসে। গভীর মনোযোগ দিয়ে পাকা বেলের সুঘ্রাণ নেয় বুকভরে। আশ্চর্য, খাবারের সুগন্ধে বেশ কিছু শক্তিও পেয়ে যায়। ডালে বসে প্রথমে নিচের মাটি দেখে। মাটি কোথায় বেশি শক্ত খুঁজে দেখতে বেল গাছের নিচে নামে। গাছটির শাখা প্রশাখা অনেক দূর ছড়িয়ে আছে। ভর দুপুরে সূর্যের ছায়া পড়েছে সরাসরি। গাছের ছায়া অনেকটা জায়গা দখল নিয়েছে। একটা ছোট অংশ ঢালাই করা।

সিমেন্ট, বালি দিয়ে কংক্রিট বানানো হয়েছে কবরস্থানের দেয়াল তৈরির কাজে। বেশ পুরানো হওয়ায় ফাঁকে কয়েক গাছি ঘাসও মাথা তুলেছে। ঠোট ঠুকরে পরীক্ষা করে দেখে কাকটা। না, বেশ কঠিন ঢালাই। এরপর ঢালাই অংশের ঠিক উপরে গাছের মগডালে বসে সে। পাকা বেল আছে কিনা দেখে গলা দুলিয়ে, তীক্ষ্ণ চোখে। হ্যাঁ আছে। বেশ ক’টা বেলে হলুদ ছোপ সাথে সুগন্ধও। সে জানে, পাকা বেলের বোঁটা নরম। কাঁকটা পাকা বেলভারে নত ডালটার আগায় কয়েক লাফে সরে যায়। তারপর-- শরীরের সব শক্তি একবিন্দুতে এনে দেয় জোর ঝাঁকি। ডালটা একটু জোরে কেঁপে উঠে। ঝরে পড়ে ক’টা পাকা বেল। দু’টো ঢালাই করা অংশে। অনেক উপর থেকে আছড়ে পড়ায় দু’টোই ফেটে যায়। বাতাসে ঢেউ ভাঙে মনোলোভা সৌরভ। দাঁড় কাকটা নিজের সাফল্য উদযাপন করে গাছের ডালে হাল্কা ঠোকর ও পাখা ছড়িয়ে দিয়ে।

নেমে আসে মাটিতে। ফাটা অংশে ঠোকর দিয়ে একটা বেল দু’ভাগ করে ফেলে। তারপর মজা করে গিলে পেটের থলি ভরে নেয়, যতটুকু সম্ভব।

তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলে, ‘দেখ মানুষ, বেল পাকলে কাকের কী! কাকের অনেক কিছু কেন, সবকিছু-হ্যাঁ সবকিছুই!

তোরা ফেল -ফেল -ফেল!!’

লেখক: গল্পকার, সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট

বাংলাদেশ জার্নাল/কেআই

  • সর্বশেষ
  • পঠিত