ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৫৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -৪৩)

  শাহজাহান সরদার

প্রকাশ : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৯:২১  
আপডেট :
 ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৯:৩৬

রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -৪৩)

দেশের জনপ্রিয় দুটি পত্রিকার (যুগান্তর, বাংলাদেশ প্রতিদিন) জন্মের পেছনের ইতিহাস, কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেয়া বিব্রতকর বিভিন্ন আদেশ নির্দেশ, হস্তক্ষেপ, পত্রিকা প্রকাশের ওয়াদা দিয়ে অন্য একটি জনপ্রিয় পত্রিকা থেকে নিয়ে এসে পত্রিকা না বের করে হাতজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিদায় দেয়া, পত্রিকা প্রকাশের পর কোন কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কিছু দিনের মধ্যেই ছাপা সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে লাভ খোঁজা, ইচ্ছেমত সাংবাদিক-কর্মচারি ছাঁটাই করা সহ পত্রিকার অন্দর মহলের খবরা-খবর, রাজনৈতিক মোড় ঘুড়িয়ে দেয়া কিছু রিপোর্ট, সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির কিছু ঘটনা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে আমার এ বই ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’। জানতে পারবেন সংবাদপত্র জগতের অনেক অজানা ঘটনা, নেপথ্যের খবর।]

(পর্ব -৪৩)

নেতৃত্বে

দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে রিপোর্টার হিসেবে মাঠে ঘাটে দৌড়ে অনেক রিপোর্ট করেছি। ঘুরেছি জেলায় জেলায়। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের সফরসঙ্গী হয়ে সংবাদ সংগ্রহ করেছি। বিদেশেও অনেক সফর করেছি। আবার সম্পাদক হয়ে ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে পত্রিকার সবধরনের কার্যক্রম পরিচালনার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। এরই মাঝে সুযোগ হয় সাংবাদিক ইউনিয়ন, সাংবাদিকদের সংগঠনের নেতা নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালনেরও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে অন্য কোন চাকরি না খুঁজে সোজাসুজি সাংবাদিকতায় আসি। রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু। তখন থেকে সাংবাদিকতা পেশা। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময়ে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করেছি। সাংবাদিকতা শুরু সেখান থেকেই। ১৯৭৫ সালে চারটি দৈনিক ছাড়া অন্য পত্রিকাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে ওই সাপ্তাহিক পত্রিকাটিও বন্ধ হয়ে যায়। পরে অন্যান্য পত্রিকা প্রকাশিত হলেও আমার জীবনে প্রথম কাজ করা সেই সাপ্তাহিক পত্রিকাটি আর প্রকাশ হয়নি। সেই পত্রিকার নাম সাপ্তাহিক ‘প্রসঙ্গ’।

পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সে সময়কার সাধারণ সম্পাদক আলী আকসাদ। এই সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা। সাপ্তাহিক প্রসঙ্গ শান্তি পরিষদের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয়। বামপন্থী আলী আকসাদ একসময় সাংবাদিক ছিলেন। দৈনিক ইত্তেফাকেও কাজ করেছেন। পরে সম্পৃক্ত হন শান্তি পরিষদের সাথে। আমৃত্যু তিনি শান্তি পরিষদের সঙ্গেই ছিলেন। বিশ্ব শান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জুলিওকুরি শান্তি পদকে ভূষিত করা হয়। এই শান্তি পরিষদই ঢাকায় পদক বিতরণে বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বিশ্ব শান্তি পরিষদ তখন বিশ্বব্যাপী অনেক বড় সংগঠন। আজও তা আছে। তবে এত শক্তিশালী নয়। বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের নেতৃত্বে মূলত আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীদের আধিক্য। তখন এই সংগঠনে মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের দাপট ছিল বেশি। আলী আকসাদও ছিলেন কমিউনিস্ট। আমি আকসাদ সাহেবের মুখে শুনেছি সাপ্তাহিক প্রসঙ্গের ব্যয়ের একটি বড় অংশ বহন করতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি থেকে পত্রিকাটি প্রকাশ শুরু হয়। আমি ছিলাম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। আমরা চার-পাঁচ জন কাজ করতাম। এর মধ্যে আকসাদ ভাইয়ের এক ভাতিজা মলয়ও ছিলেন। আর একজন হিসাবরক্ষক ও একজন পিয়ন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে যেতাম। আলী আকসাদের কাছ থেকেই প্রথম সাংবাদিকতা শেখা। লিখতাম আবার প্রকাশনাও দেখতাম।

পত্রিকাটি ছাপা হত নওয়াবপুরের অভ্যুদয় নামের একটি প্রেস থেকে। একই প্রেসে তখন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত ‘কণ্ঠস্বর’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন ছাপা হত। প্রেসে প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা হতো। তিনি তখন ঢাকা কলেজের অধ্যাপক। প্রসঙ্গ পত্রিকায় তখন ‘হিং টিং ছট’ নামে একটি কলাম লিখতেন আজকের সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। তখন তিনি ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের চিফ সাব-এডিটর। আর লিখতেন দৈনিক সংবাদের তৎকালীন সিটি এডিটির হাসান আলী। তার স্ত্রী বেবী মওদুদও লিখতেন। আর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ের অনুবাদ করতেন নাজীমউদ্দিন মোস্তান। বেবী মওদুদ তখন সংবাদের রিপোর্টার আর নাজীমউদ্দিন মোস্তান সংবাদের সাব এডিটর। বেবী মওদুদ ছিলেন একজন বিচারপতির কন্যা, আর হাসান আলী পঞ্চগড়ের এক মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের পরিচয়। সেই সূত্র ধরেই সম্পর্ক এবং বিয়ে। দু’জনই তখন সংবাদে। তাদের বাসা ছিল তোপখানা রোডে। আর প্রসঙ্গ অফিসও তোপখানা রোডে। জাতীয় প্রেসক্লাবের উল্টোদিকে বিশাল যে পরিসংখ্যান ভবন এর তৃতীয় তলায় বাংলাদেশ শান্তিপরিষদের অফিস। এই অফিসের দু’টি রুম নিয়ে করা হয় সাপ্তাহিক প্রসঙ্গ অফিস। প্রসঙ্গ অফিসেই বেবী আপার সাথে আমার পরিচয়। তিনি প্রথম দিন থেকেই আমাকে ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করতেন। প্রসঙ্গ অফিসে হাসান আলী সাহেব এলে প্রায় দিনই তিনি আমাকে বাসায় দুপুরের খাবারের জন্য নিয়ে যেতেন। বেবী মওদুদ চাকরি করেও নিজ হাতে রান্না করতেন। প্রথম থেকেই বেবী আপা আমাকে সাংবাদিকতায় আসার জন্য উৎসাহ দেন। তখনও ভাবিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেব।

১৯৭৫ সালে প্রসঙ্গ বন্ধ হয়ে গেলেও বেবী মওদুদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকে। তিনি তখন চাকরি নেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ তথ্য অধিদপ্তরের ফিচার ব্যুরোতে। মাঝে মাঝে আমিও ফিচার লিখতাম। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার অনুপ্রেরণায় সরাসরি দেশের প্রাচীনতম দৈনিক আজাদ-এ স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করি। প্রসঙ্গত আমরা যারা কাজ করতাম এক দশকের মধ্যে মোটামুটি সবাই দৈনিক ইত্তেফাকে আবার একসাথে হই। গোলাম সারওয়ার তখন বার্তা সম্পাদক হয়ে যান। মোস্তান সাহেব সংবাদ থেকে ইত্তেফাকে গিয়ে সিনিয়র রিপোর্টার, বেবী মওদুদ মহিলা পাতার দায়িত্বে। আমি সবার পরে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করি। এই বেবী মওদুদকে সাংবাদিকরা সবাই জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বান্ধবী হিসেবে। একসাথে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর শেখ হাসিনা দেশে ফিরে যাদের কথা প্রথম বলেন তাদের মধ্যে বেবী মওদুদ একজন। তিনি এখন আমাদের মাঝে নেই। নির্লোভ, নিরহংকারী বেবী মওদুদ আজীবন বঙ্গবন্ধু কন্যার সুসময়ে, দুঃসময়ে পাশে ছিলেন। নবম সংসদে তিনি সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি ছিলেন। তিনি সর্বশেষ দেশের প্রধান অনলাইন সংবাদ সংস্থা ও সংবাদপত্র বিডিনিউজ-এর সোশ্যাল ওয়েলফার এডিটর ছিলেন। বেবী আপার স্বামী হাসান আলী মারা গেছেন আরো অনেক আগে। সংবাদ বন্ধ হয়ে যাবার পর তিনি আর সাংবাদিকতায় ফেরেননি। সরকারি চাকরি দেয়া হলেও তা নেননি। ওকালতি পেশা শুরু করেন। পেশায় ভালই করছিলেন। কিন্তু অকালেই মারা গেলেন হাসান ভাই। আর বেবী আপাও অনেক স্মৃতি রেখে চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে।

বলেছিলাম দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে কয়েক বছর ইউনিয়ন ও সাংবাদিকদের সংগঠনের নেতা নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আশির দশকের শুরুতেই আমি সাংবাদিক ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত হই। তখন ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী। সাংবাদিকদের অধিকার ও দাবি-দাওয়া আদায়ে বলিষ্ঠ ও সংগ্রামী ভূমিকা পালন করে আসছিল। এখন সাংবাদিক ইউনিয়নে বিভক্তির কারণে নেতৃত্বের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় শাক্তিশালী ভূমিকা পালন সম্ভব হয় না। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) সাংবাদিকদের শীর্ষ সংগঠন। এর অধীনে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নসহ বিভাগীয় জেলা পর্যায়ের ইউনিয়ন। আমার ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সময় ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বগুড়া, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, রংপুর ও যশোরে সাংবাদিক ইউনিয়নের ইউনিট ছিল। তখন ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচনে ভোটার ছিলেন কাউন্সিলররা। অর্থাৎ প্রতিটি ইউনিটের ১০জন ভোটার মিলে একজন কাউন্সিলর নির্বাচিত করতেন। এই কাউন্সিলররা ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করতেন সভাপতি, সাধারণ সম্পাদসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি। এখন সরাসরি ভোট। কাউন্সিলর সিস্টেম নেই। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আমি বিএফইউজের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদে নির্বাচনের জন্য আমার ফোরাম থেকে মনোনীত হই। তখন ইউনিয়ন ছিল একটি। আর ফোরাম দুটি। একটি আওয়ামী লীগ ও মস্কোপন্থীদের সমর্থিত। অন্যটি তখনকার ডানপন্থী, বিএনপি ও চীনাপন্থীদের সমর্থিত। আমি প্রথম থেকেই প্রথমোক্ত ফোরামের পক্ষে। বিএফইউজে’র এই পদে সাধারণত আগে থেকে যারা ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন থেকে নির্বাচন করে আসছেন তারাই মনোনয়ন পান। আর আমি আগে ইউনিয়নের কোন নির্বাচনে অংশ নেইনি। এরপরও মনোনয়ন পাই। নির্বাচিত হই সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে।

প্রথমবার আমাদের সভাপতি ছিলেন হাবিবুর রহমান মিলন ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ জাফর। সফলভাবে প্রথম মেয়াদের দু’বছর পার হয়। দ্বিতীয়বারও আমি একই পদে নির্বাচন করে জয়ী হই। সেবারও সর্বোচ্চ ভোট। তখন সভাপতি ছিলেন রিয়াজউদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আমানুল্লাহ কবীর। এই দু’ কমিটিতেই তৎকালীন দুই ফোরমের শীর্ষ নেতা যেমন ইকবাল সোবহান চৌধুরী, গিয়াস কামাল চৌধুরীও ছিলেন। তারা নির্বাহী কমিটির সদস্য পদে নির্বাচিত এবং মনোনীত হন। দ্বিতীয় মেয়াদের পর আমি ইউনিয়ন কার্যক্রম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেই। আমি মনে করেছি ইউনিয়ন ও সাংবাদিকতা দু’টি সমানতালে করা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। একটি করতে গিয়ে আরেকটির ক্ষতি হচ্ছে। তাই ইউনিয়ন পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতায় মনোযোগ দেই। এর সুফলও আমি পেয়েছি। মেধা, শ্রম দিয়ে একাগ্রভাবে কাজ করার কারণেই হয়তো আজ আমি সম্পাদক। আর ইউনিয়ন করলে ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়নেরও আরো বড় নেতা হয়তো নির্বাচিত হতে পারতাম। আর বর্তমান ইউনিয়নের সর্বোচ্চ পদেও নির্বাচিত হয়ে যেতে পারতাম। তবে আমি বর্তমান অবস্থায়ই খুশি। কেননা নিরেট সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করে থাকতে চাই। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে চাই। তবে আমি কিন্তু ইউনিয়নসচেতন। এখনও আমার পছন্দের ফোরামের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক আমি। কেননা আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেই সঙ্গে রাজনীতি সচেতন।

চলবে...

বইটি পড়তে হলে সপ্তাহের রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতিবার চোখ রাখুন ‘বাংলাদেশ জার্নাল’ অনলাইনে।

বইটি প্রকাশ করেছে উৎস প্রকাশন

আজিজ সুপার মার্কেট (তৃতীয় তলা), ঢাকা।

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে ক্লিক করুন

আরএ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত