ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

সন্ধ্যে নামার আগে

  মুত্তাকীন রশিদ আলভী আলাদিন

প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২১, ২২:২৫

সন্ধ্যে নামার আগে

কাল রাত হতে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষার মাঝামাঝি সময় বলেও এমন হতে পারে। চারপাশ বৃষ্টি আর মাটির গন্ধের অদ্ভুত এক সংমিশ্রণ ঘটেছে যে কাউকে হঠাৎ করে স্তব্ধ করে দিতে বাধ্য।মুষুলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।আজ যেন বর্ষণের কোন মানা নেই। কৃষ্ণচূড়া ও কদমফুল বৃষ্টির একেকটা বিন্দুর স্পর্শে যেন তাদের যৌবন ফিরে পেয়েছে।শ্রাবণ মাসের এমন সময়ে ঠোঁটের কোণে একটা গান চলেই আসে,

"আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে!

জানি নে,জানি নে

কিছুতে কেন যে মন লাগে না!"

-অনু! এই অনু! অনু পেছনে তাকিয়ে দেখে বাবা দাঁড়িয়ে আছে।

-হ্যাঁ, বলো বাবা।

-আজ ক্লাস নেই?

-ছিল বাবা, সকাল থেকে যে বৃষ্টি তাই আর যেতে পারলাম না।

-জানিস তো! বর্ষাকাল তোর মায়ের ও অনেক পছন্দের ঋতু ছিল। যখনই বৃষ্টি নামবে তোর মা বারান্দার গ্রিল ধরে অপলকভাবে বাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকতো,ঠিক তোর মতন করেই।আজ দেখ বৃষ্টি ঠিকই সময়মতো চলে আসে কিন্তু যার অসম্ভব প্রিয় ছিল সে আজ আমাদের মাঝে নেই।

কথাটি বলতে বলতেই শফিক সাহেবের চোখের কোণে পানি চলে আসে। - আচ্ছা বাবা! জীবন কি এতোটাই কঠিন যার সহজ কোন পথ নেই,যে পথটা ধরে আমরা সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারব?

শফিক সাহেব কথাটি শোনার পর মৃদ্যু হেঁসে বললেন, "জীবন চলার পথে আমরা কঠিন সহজ বহু ধরণের পথের সম্মুখীন হবো,কখনো বা হারিয়ে যাবো অজানা গন্তব্যের দিকে বা দিকহীন বহু রাস্তায়।আর সঠিক পথের সম্মুখীন হওয়ার আগে আমাদেরকে অনেক ভুল পথের মুখোমুখি হতে হবে কিছুটা ইচ্ছাকৃতভাবে আবার কিছুটা অনিচ্ছাকৃতভাবে।" -আর জীবন সংগ্রামে যদি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারি,বাবা তখন?

-"জীবন নামক কাব্যগ্রন্থে অজানা অনেক অধ্যায় আসবে কিছু অধ্যায় আগে থেকেই পঠিত,আর কিছু অধ্যায় নতুন অজানা শিখন ফল হিসেবে নিতে হবে, অনু!"

বাবার কথাগুলো বারবার অনুকে উৎসাহিত করে, প্রতিনিয়ত। মা মারা যাবার পর বাবা স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছেন একজন মায়ের মতো করে, আবার পরোক্ষণে বাবার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন প্রচন্ড ধৈর্য্যের সাথে।

আমি বাবাকে প্রায় এই কথাটি বলেই ফেলি,

-এতো ধৈর্য্যে কেন তোমার বাবা?একজন মানুষের এতো ধৈর্য্যে কিভাবে থাকতে পারে! আমি বারবার মুগ্ধ হয়ে যাই।

তখন বাবা সেই হাস্যেজ্জ্বল চেহারা নিয়ে বলে,

"জীবন চলার পথে তোকে নানান ধরণের আকস্মিক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে,তোকে সব ক্ষেত্রে এই ধৈর্য্যে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে!"

বাবার প্রতিটা কথার মর্ম অনুর কাছে অবিস্মরণীয় হরফের মতো,যা অনু মেনে চলতে চায় তার জীবনের প্রতিটি পদে পদে।মা মারা যাবার সময় আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে কয়েকটা কথা বলেছিলেন।যা আজও আমার কানের কাছে কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হয়।মা বলেছিলেন,

"তোর বাবা কিন্তু আর আট দশটা পুরুষ মানুষের মতো নয়।কখনোই তোকে তার ভেতরের খারাপ লাগার কথা বলবে না,এমনকি তোকে বুঝতে ও দিবে না অনু! এতোদিন খুব সামলিয়ে রেখেছিলাম তোর বাবাকে। আমার মতো করেই ঠিক আগলিয়ে রাখতে পারবি মা?"

কথাগুলো মনে করতেই মায়ের চেহারা ক্ষণিকের জন্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো।

অনেকক্ষণ থেকে টিনের চালের উপর ইটের টুকরো নিক্ষেপের শব্দ শোনা যাচ্ছে। প্রথমে তেমন বোঝা না গেলেও এখন স্পষ্ট কানের কাছে শব্দটি লাগছে। মাঝরাত হলেই এমন শব্দ শোনা যায়। আগে কয়েকদিন পর পর শোনা যেত, এখন রোজ মধ্যরাতে এমন শব্দ শোনা যায়। মা ও ছোট ভাই হিরণকে নিয়ে ছোট্ট এই ঘরটাতে হঠাৎ করেই বাহিরের অনুমতিহীন শব্দগুলো অনেকটা অস্বস্তির মতো লাগে ঝর্ণার কাছে। সে ঠিকই বুঝতে পারে, শব্দগুলো আকস্মিক নয় বরং মানুষ নামক কিছু ভয়ংকর প্রাণীর দ্বারাই সংঘটিত।

পাহাড়ি মেয়ে ঝর্ণা। রাঙামাটির বরকল উপজেলার সুবিশাল পাহাড় গুলোকে দেখেই রোজ তার ঘুম ভাঙে। প্রতিদিন সে তার স্বপ্নকেও এখানকার পাহাড়গুলোর মতোই বিশাল করে গড়ে তোলে।তার স্বপ্ন এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। পাহাড় যেমন মেঘকে স্পর্শ করে সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে ঝর্ণা ও তেমন তার লালিত স্বপ্নকে রোজ রোজ স্পর্শ করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঝর্ণার ইচ্ছে কুসংস্কার সম্পূর্ণ এই অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে সে তার মা আর ভাইকে বের করে নিয়ে যাবে।

বাবার হঠাৎ করে একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর ঝর্ণার মা লতিকা বানু অন্যের ক্ষেতে দিনমজুর করে যা আয় করে তা দিয়ে খুব ভালো ভাবে না হলেও একবেলা অন্ন জুটেই যায়।

সকাল থেকেই আজ পাহাড়ের আশে পাশে বেশ মানুষের ভীড় সমাগম দেখা যাচ্ছে।

ঝর্ণা হিরণকে ডেকে বললো,

- কিরে হিরণ আজ এতো মানুষ কেন?

-বুবু জানিস!ঢাকা হতে কে যেন এসেছে।

-ঢাকা থেকে?

-হ্যাঁ, বুবু।মানুষদের হাতে কি সব যন্ত্রপাতি দেখছি।

-আচ্ছা,আমি নিজেই গিয়ে দেখে আসি। কে আসছে ঢাকা থেকে। এই বলে ঝর্ণা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

বের হতেই দেখে তাদের ঘরের বাহিরে সুর্দশন একজন পুরুষ মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে কি যেন একটা নিয়ে। ঝর্ণা কোন কিছু বলার আগেই, শাহেদ জিজ্ঞেস করলো-

- আচ্ছা,আপনি কি ঝর্ণা?

- হ্যাঁ,কেন বলুন তো?

-আপনাকে আমার দরকার।

- মানে?

- মানে হলো,আমি একজন সাংবাদিক ঢাকা থেকে এসেছি। আপনি বলে এখানকার সব পাহাড় আর ঝর্ণাগুলোর অবস্থান জানেন।আমি একটা ডকুমেন্টারী তৈরী করবো সেজন্য এসবের তথ্য আমার দরকার।এইজন্য আপনার সাহায্যের প্রয়োজন ছিল।

- ঝর্ণা কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর রাজি হয়ে গেল শাহেদের প্রস্তাবে।

সারাটা দিন শাহেদকে নিয়ে ঝর্ণা বরকলের সব পাহাড় পর্বত ঘুরে ঘুরে দেখালো।

-রাঙামাটি জেলার সবচেয়ে প্রাচীনতম উপজেলা বরকল। বৃটিশ শাসনামলে এটি কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল। ঝর্ণা শাহেদকে বললো।

- হ্যাঁ, আমিও শুনেছি। এইজন্য রাঙামাটির প্রতিটা জায়গার প্রতি অন্যরকম আর্কষণ কাজ করে আমার। শাহেদ ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো।

-আরেকটা বিষয়, বরকল নামকরণের পেছনে জনশ্রুতি আছে, কর্ণফুলী নদীর এই জায়গায় একটি বড় প্রবাহমান ঝর্ণা ছিল। পানি পড়ার শব্দ নাকি অনেক দূর থেকে শোনা যেত।আর এই পানি পড়ার শব্দ শুনে মনে হতো কোন বড় যন্ত্র বা কলের শব্দ হচ্ছে।যার কারণে এই স্থানে বসবাসকারী পাহাড়ী লোকেরা এর নাম দেয় "বরকল"! মধ্যযুগের পুঁথিতে যদিও কর্ণফুলী নদীটি কাঁইচা খাল নামে লিখিত ছিল।তবে মার্মা উপজাতিদের কাছে নদীটির নাম " কান্সা খিওং" এবং মিজোরামে কর্ণফুলীর নাম" খাওৎলাং তুইপুই" ঝর্ণা হেসে হেসে বললো।

শাহেদ নির্বাকভাবে ঝর্ণার হাসির দিকে তাকিয়ে ছিল।

-জানেন! ভরা পূর্ণিমা আর বৃষ্টির সময় পাহাড় অন্য রূপ ধারণ করে। চাঁদের আলোয় পাহাড়ের গায়ে মখমলের চাদরের মতোই মনে হয়।ঠিক রূপালী চাদর পুরো পাহাড়কে আচ্ছন্ন করে ফেলে।আর বৃষ্টির পানি পাহাড়কে নতুন করে চিরসবুজ করে তোলে।যতোদূর চোখ যাবে সতেজ এক আভা যা দেখে আপনার চোখ দুটো জুড়িয়ে আসবে।

ঝর্ণা অনেকটা আশ্বস্ত করেই কথাগুলো বললো।

- বাহ! আপনি তো দেখি অনেক কিছুই জানেন।

- আমার জানার ইচ্ছে আরও বেশি। এজন্য সব সময় শিখি সব দিক দিয়ে আর ও শিখতে চাই। ঝর্ণা শাহেদের দিকে তাকিয়ে বললো কথাটা।

- শাহেদ ঝর্ণার কথায় মুগ্ধ হয়ে গেল,মনে মনে ভাবলো মেয়েটার মধ্যে কিছু একটা আছে।এখানকার প্রকৃতির মতো যাকে স্পর্শ করা যাবে না,মুগ্ধতার মায়াজালে আছন্ন করে ফেলবে খুব তীব্রভাবে।

- আমার ঝুলিতে এতোটুকুই ছিল,ঝর্ণা হেসে হেসে শাহেদকে বললো। আজ আসি।

যাওয়ার আগে শাহেদ ঝর্ণাকে ডেকে বললো,এই নেন আমার কার্ড যদি কখনো ঢাকায় আসা হয় তাহলে অবশ্যই দেখা করবেন। শাহেদ চলে যাওয়ার সময় ঝর্ণা অনেকক্ষণ ধরে তার পথের দিকে চেয়ে ছিল,এই বুঝি শাহেদ পেছনে একবারের জন্য হলেও ফিরে তাকাবে। কিন্তু শাহেদ ফিরে তাকায়নি,ঝর্ণা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডুবন্ত সূর্যের ছায়ার সাথে শাহেদের ছায়াকে মিশে চলে যেতে দেখল।ঠিক সন্ধ্যে নামার আগে!

অনু আজ খুব তাড়াতাড়ি উঠে বাবার পছন্দের খিঁচুড়ি আর বেগুন ভাজা রান্না শুরু করে দিল।বৃ্ষ্টির দিনগুলোতে বলা যায় বাবার আবদার থাকে।

"গরম গরম খিঁচুড়ি আর সাথে বেগুন ভাজা"!অনু খুব শখ করে পায়েস রান্না করেছে।রাফির জন্য। একদিন কাম্পাসে সবার মাঝে গল্প করার সময় হেসে হেসেই অনুকে রাফি বলেছিল-

" আজ অবদি তোমার হাতের পায়েস খাওয়া আর হয়ে উঠলো না অনু!এ যেন ডুমুরের ফুল!"

কথাটা খুব সহজভাবে বললেও অনু ঠিকই টের পেয়েছিল রাফির অপ্রকাশিত কথাগুলো।

বাবা,আজ ফিরতে একটু দেরি হবে। তুমি খেয়ে নিও আমার জন্য অপেক্ষা করো না যেন। অনু ক্লাসের জন্য বের হওয়ার সময় কথাগুলো শফিক সাহেবকে বললো।

আসার সময় আমার মেডিসিনগুলো নিয়ে আসবি মনে করে,এইখানে মেডিসিনগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। আচ্ছা বাবা আমি নিয়ে আসবো।বলেই অনু বের হয়ে গেল।

আজ এসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার শেষ দিন।অনু সবার আগেই জমা দিয়ে দিয়েছে। পেছন থেকে রাফি অনুকে ডাক দিয়ে বলে,

- সবসময় সবার আগে এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে দাও কিভাবে, অনু?

-আমি কাজ ফেলে রাখতে পছন্দ করি না,রাফি।

-তোমার এই দিকটাই তো আমার সবচেয়ে পছন্দ।

- কি বললে?

- না কিছু না,রাফি কথার প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্টা করলো।

-আজ ফ্রি আছো অনু?

- নাহ,ক্লাস শেষ করে লাইব্রেরিতে যেতে হবে। তারপর মেডিসিন এর দোকানে।

-আমি তোমার সাথে যেতে পারি?

রাফি একপ্রকার আকুতি করেই কথাটা বললো।

-আচ্ছা,চলো তবে।অনু সম্মতি দিল।

রাফি আর অনু তিনবছর থেকে একসাথে পড়াশোনা করছে।দুইজনই ভালো বন্ধু কিন্তু এই বন্ধুত্বের মাঝে অজানা এক অদৃশ্য সুতো আছে যার উপস্থিতি কেউ কাউকে কোনদিন বুঝতে দেয়নি।লাইব্রেরীর কাছাকাছি এসে রাফি হুট করে অনুকে বললো,আমি চলি তাহলে অনু।কাল ক্লাসে আবার দেখা হবে। অনু চাইছিল রাফি তার সাথে থাকুক,আরও কিছুক্ষণ থাকুক।কিন্তু সে তা বললো না।

- আসি অনু!

-এসো।বলেই অনু লাইব্রেরির ভেতর ঢুকে পড়লো।রাফির জন্য বানানো পায়েসটি ও দেওয়া হলো না অনুর।

পাশের রাস্তার পথ ধরে রাফি হেঁটে হেঁটে চলে গেল।ঠিক সন্ধ্যে নামার আগে!

বই নিয়ে মেডিসিন নিতে নিতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। আকাশ থমথমে হয়ে আছে।যেকোন মুহুর্তে ঝুম বৃষ্টি নামবে।শফিক সাহেব চিন্তিত হয়ে অনুকে ফোন দিলেন,

- কোথায় মা তুই এখন?

- বাবা,আসছি আমি,কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের রাস্তায়।

- তাড়াতাড়ি চলে আয়,বৃষ্টি আসতে পারে।

- চিন্তা করো না বাবা,আমি আসছি।

ফোনটা রেখেই অনু রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।রাত তখন খুব একটা বেশি নয়, নয়টা বেজে দশ মিনিট। ঠিক এমন সময়ে দূর হতে একটা মাইক্রোবাসের দেখা পেল।প্রথমে অনুর মনে হলো,মাইক্রোবাসের ভেতরে কেউ নেই।কিন্তু যখন কাছে এসে থামলো গুণে গুণে ছয়জনের উপস্থিতি অনু টের পেল।

-আপা,কোথায় যাবেন?

-অনু কিছু বললো না।

-কোথায় যাবেন বলেন, আমরা লিফট দিতে পারব।নাহ,আমি অপেক্ষা করছি রিকশার জন্য।ধন্যবাদ!

তারপর হঠাৎ করে মুষুলধারে বৃষ্টি শুরু হলো।অনুর পুরো শরীর বৃষ্টির পানিতে ভিজে যেতে লাগল।দূরে দাঁড়ানো মাইক্রোবাসের ভেতরের ক্ষুধার্ত চোখগুলোর ভয়াল দৃষ্টির বেড়াজালে অনুর ভেজা শরীর আবদ্ধ হয়ে গেল।

রাত বারোটা বেজে ঠিক পনেরো মিনিট। রিকশার জন্য অপেক্ষা করার সেই স্থানটিতেই অনুর স্থবির দেহটি পড়ে রইল।

পরের দিন খবরের কাগজের প্রথম পাতার হেডলাইন" ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর ধর্ষণ"সন্দেহভাজন অজ্ঞাত মাইক্রোবাসের হওয়ায় এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করা হয়নি। হেডলাইনটি পড়ে রাফি কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল।

অনুর জ্ঞান সবেমাত্র ফিরেছে।শফিক সাহেব তার মেয়ের হাত খুব শক্ত করে চেপে ধরে বসে আছেন।কেউ কোন কথা বলছে না।নিস্তব্ধতার মাঝেও অনেক ভারী কথোপকথন বয়ে যাচ্ছে বাবা ও মেয়ের মাঝে।অনু তখন পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে ঘড়িটার দিকে।ঘড়ির কাটায় তখন বাজে নয়টা বেজে দশ মিনিট।

ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল।অথচ অনুর কাছে একেকটা ঘন্টা একেকটা মুহুর্ত যেন ভয়াবহ এক কালোরাত্রির মতো মনে হতে লাগলো। আয়নার সামনে দাঁড়াতেও যেন সাহস হয়ে উঠছিল না। নিজের শরীরে হাত দিতে গেলেই অপরিচিত সেই স্পর্শগুলোর মর্মান্তিক অনুভূতি অনুর ভেতরটা ভেঙে ছাড়খাড় করে দিতো।সে কোনভাবেই ভুলতে পারছে না।রাতে লাইট অফ করে ঘুমানোও তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ল।চোখ বন্ধ করলেই ছয়জন মানুষের মতো দেখতে হিংস্র অমানুষ নামক প্রাণীর প্রতিচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠে আর সাথে সাথে অনুর ঘুম ভেঙে যায়।কেমন এক দমবন্ধকর পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে অনুকে দিন রাত অতিবাহিত করতে হতো।এমন সময়ে অনু এক সিদ্ধান্তে অটল হলো,সে পুলিশের কাছে যেয়ে সেই নরপশুদের চেহারার বিস্তারিত বিবরণ নিজেই গিয়ে দিয়ে আসবে।

ঝর্ণা আজ সারাদিন মায়ের সাথে ক্ষেতের কাজ করেছে। শরীর জুড়ে ক্লান্তির ছাপ।মা এখনো বাড়ি ফেরেননি। হিরণও ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ করে বাড়ির দরজায় সজোরে বার কয়েক শব্দ হলো। মা! তুমি এসেছো! দাঁড়াও আসছি বলেই,ঝর্ণা দরজা খুলে দেখে চারজন পরিচিত মুখ। পাশের গ্রামের আনোয়ার চাচার ছেলে হাসান ও তার বন্ধুরা। এই সময় কেন এসেছো কথাটি বলার সুযোগ না দিতেই তারা ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো। ছোট ভাই হিরণের ও ঘুম ভেঙে গেল শব্দে।ঘরের দরজা লাগিয়ে চার নরপশু তাদের বহুল প্রতিক্ষিত অপকর্মের মধ্যে দাঁড়ি চিহ্ন বসিয়ে দিল।ঝর্ণার শরীরে হিংস্র ক্ষুধার্ত প্রাণীর মতো ঝাপিয়ে পড়লো এক এক করে।প্রচন্ড চিৎকার এবং আর্তনাদে ঝর্ণার কন্ঠ ভারী হয়ে গেল।মুখের ভেতর কাপড় ঢুকিয়ে দিয়ে ঝর্ণার কন্ঠস্বরকে তারা থামিয়ে দিল।এক মুহুর্তের জন্যে তারা রেহাই দিল না।শারীরিক নির্যাতনের চরম মাত্রায় তারা ঝর্ণার শরীরের উপর দীর্ঘ দিনের তাদের ভেতর জমিয়ে রাখা লালসাকে তিলে তিলে পূর্ণ করলো।ঝর্ণার চোখের রক্তাক্ত অশ্রুর সাথে এক প্রকার নির্মম অসহায়ত্ব চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল।

সারা শরীর জুড়ে প্রচন্ড ব্যথা। শরীরের বেশিরভাগ অংশে কেঁটে যাওয়ার ও ক্ষতবিক্ষতের চিহ্ন কাল রাতের ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের প্রমাণ স্বচ্ছ পানির মতো দেখিয়ে দিচ্ছে।গলার কাছে আর পিঠের দিকের চামড়ার রক্ত শুকিয়ে গেছে। কতোটা নির্মম হলে এমন পাশবিক আচরণ করতে পারে।

ঝর্ণার শরীরে হাত দিয়ে স্পর্শ করে লতিকা বানু দেখছিলেন আর চোখ দিয়ে তার শব্দহীন এক আর্তনাদ বয়ে আসছিল।

কোথাও কেউ নেই প্রতিবাদ করার মতো।সবাই সব সত্যটা জেনেও একদম চুপ,নির্বিকার হয়ে আছে। কারণ তারা ক্ষমতাসীন লোক। কিন্তু লতিকা বানু হেরে যাওয়ার দলে না,জীবন সংগ্রামে তিনি প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলেছেন।আজও করবেন। তার নিজের মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের একটা ব্যবস্থা করেই ছাড়বেন।লতিকা বানু ঝর্ণার মাথায় হাত দিতে গেলেই,ঝর্ণা তার চেপে রাখা কান্নাকে আর আটকিয়ে রাখতে পারল না।কাঁদতে কাঁদতে সে মাকে বললো, এই যে মা শাহেদ সাহেবের নাম্বার।উনি ঢাকার একজন সাংবাদিক!

সারাদেশে যখন ধর্ষণের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে দেশের জনগণ প্রতিবাদের মিছিল,এমনকি মেয়েদের অধিকার নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যাচ্ছেন।তারা কি এতোটাই সচেতন মেয়েদের নিয়ে? ধর্ষকদের মানবিকতার বিকার লোপ এমন নিম্নভাবে নেমেই চলছে যে তারা বিন্দুমাত্র না ভেবেই অপরাধের পর অপরাধ করেই চলছে। এমন ঘটনা এখন যেন নিত্যদিনের সঙ্গী।বাড়িতে বসে কিছু জনগণ প্রতিবাদের সামান্য কথা দ্বারাই এসব ঘটনাগুলোকে সিজনাল টপিক ইস্যু করে ফেলছে,খুব সুন্দরভাবে।যার মেয়াদ শেষ ও হয়ে যায় আরেক টপিকের আগমন দ্বারা। মেয়েদের পোশাক,চালচলনকে দায়ী করছে কুসংস্কার সম্পূর্ন এক অজ্ঞাত শ্রেণী।তাহলে নয়মাসের শিশুর পোশাকে কি দোষ ছিল? বা পবিত্র ধর্মীয় রীতির অনুসারীরা মাদ্রাসায় যেয়েও রেহাই পাবে না? ছেলে শিশুদেরও কি পোশাকের দিকে খেয়াল রাখতে হতো? আদৌ কি তা আমাদের দেশের জন্য ঠিক হচ্ছে? দেশের মানুষের জন্য ঠিক হচ্ছে? এসব কিছু প্রশ্ন আজীবন প্রশ্ন হিসেবেই থেকে যাবে।প্রতিবাদের প্রধান স্থান রাস্তার মিছিল দিয়ে না হয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেদের মানবিকতার কাছে করতে হবে,অনেকটা সুষ্ঠুভাবে।

শাহবাগের প্রচন্ড ভীড়ের মাঝে রাফি খুব শক্ত করে অনুর হাতটা চেপে ধরে আছে।অনু একবার রাফির দিকে তাকালো,তারপর প্রতিবাদী আন্দোলনের কন্ঠের জোয়ারে নিজেকে পুরোপুরি সর্মপিত করলো।আজ লড়াইটা তার একার নয় হাজারো প্রতিবাদী কন্ঠের। অজস্র জনগণের মাঝে ঝর্ণা যখন তার দাবী আদায়ের শ্লোগানে মগ্ন এমন সময়ে শাহেদ ঝর্ণার কাধেঁ হাত রেখে তার দিকে তাকিয়ে আশ্বাসের হাসি দিলেন,এতে ঝর্ণা আরো দ্বিগুণ উদ্দ্যমতায় নিজেকে ভাসিয়ে দিল দু্র্বার মিছিলের মাঝে।

শাহবাগের মিছিলে আজ অনু আর ঝর্ণা দুইজনই উপস্থিত।তাদের পোশাক ভিন্ন,তাদের আচার- আচরণ ও ভিন্ন। তবে এক দিক দিয়ে তাদের মিল অভিন্নের চেয়েও ভয়ংকর।তাদের দুইজনের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং জ্বলজ্বলে মশাল আজ তাদের মতো হাজারো অনু ও ঝর্ণাকে একত্রিত করেছে।এক অটল বিশ্বাসের দাবিতে! দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি না হওয়ার দাবিতে!

  • সর্বশেষ
  • পঠিত