ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৮ মিনিট আগে
শিরোনাম

৭৫তম জন্মদিনে অভিবাদন ‘নীলকণ্ঠ’ শেখ হাসিনাকে

  প্রণব সাহা

প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২৩:০৯  
আপডেট :
 ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:২৫

৭৫তম জন্মদিনে অভিবাদন ‘নীলকণ্ঠ’ শেখ হাসিনাকে
প্রধানমন্ত্রী ও প্রনব সাহা ।। ছবি: নিজস্ব

শেখ হাসিনা ৭৫ বছরে পা দিচ্ছেন ২৮ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সময় যিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। আবার একটানা বেশি সময় ধরে সরকারপ্রধান হিসেবে কাজ করার কৃতিত্বের পালকটিও আছে তার সাফল্যের মুকুটে। একটানা ৪০ বছর নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে। যে দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক। আর শেখ হাসিনা তার জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় এই আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।

২৮ সেপ্টেম্বর যখন আওয়ামী লীগের অগনিত নেতা-কর্মী তাদের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার ৭৫তম জন্মদিন পালন করবে, তখন সমালোচকদের জবাব দেয়ার জন্য সবার চোখের সামনে থাকবে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সম্পূর্ণ অবকাঠামো। এখন যেই সেতুর ওপর যানবাহন চলাচলের স্লাব বসানোর কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। চলছে রেল লাইন স্থাপনের কাজও।

রাজধানীবাসীর সামনে এখন থাকছে মেট্রোরেলের হাতছানি। এরই মধ্যে তার ট্রায়াল রান দেখেছে দেশবাসী। রাজনীতি আর অবকাঠামোগত উন্নয়নের মিশ্রণে একজন সরকারপ্রধান এবং রাজনীতিকের সাফল্যের মূল্যায়ন করতে চাইলে বাংলাদেশে শেখ হাসিনাই সবচেয়ে এগিয়ে থাকবেন। একটি পুরোনো রাজনৈতিক দল বেশি সময় ধরে পরিচালনা করলে এবং একই সাথে সরকারের প্রধান নির্বাহী হিসেবে কাজ করলে ভুল বা সমালোচনার বাইরে থাকা সম্ভব নয়। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।

কিন্তু দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জাতির পিতা হত্যার বিচার করেছেন এবং তা হয়েছে দেশের সাধারণ আইনে। দণ্ডিত খুনীদের বিচারের রায়ও কার্যকর করেছেন। তার সাথে যুক্ত হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকর করার সাফল্য।

একজন রাজনীতিক যিনি ২১ বছর পর দলকে ক্ষমতায় এনেছেন, আবার যে কারণে ১৯৭৫ সালের আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল, সেই জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের বিচার করা সহজ বিষয় ছিল না। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনেও বঙ্গবন্ধুর খুনীদের অন্যতম কর্ণেল রশীদ অংশ নিয়েছিল। নির্বাচনের পর সংসদ কক্ষেই সাংবাদিকদের কাছে তার দাম্ভিক উক্তি ‘আমিই অপজিশন লিডার’ নিজে প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচন আর ২৩ জুনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার এক মাসের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনী কর্ণেল ফারুককে গ্রেপ্তার আর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা দায়ের, সে সময়ের জন্য ঝুঁকিই ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা তা করতে পেরেছিলেন। একইভাবে ২০০১ সালের বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকারের মন্ত্রী যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদীকে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠনের পরপরই গ্রেপ্তার করেও সাহস দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। দেশ স্বাধীনের ৫০ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে রায় কার্যকর করা কোনো সহজ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল না। প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি যে রাজাকারদের জাতীয় পতাকা দিয়েছিলো, সেই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝোলাতে আন্তর্জাতিক চাপও মোকাবেলা করেছেন শেখ হাসিনা।

আবার যদি মাঠের রাজনীতির সফলতার কথা বলি তাহলে ১৯৯৪ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি উত্থাপন, সেই দাবিকে সারাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে কঠোর পরিশ্রম শেষে দাবি আদায়কে একটি বড় সফলতা হিসেবে বিবেচনা করতে হয়। তবে সেই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেও তা সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট ছিল না। জাতীয় পার্টির সাথে সমঝোতা শুধু নয়, রীতিমত সরকারের অংশী করা হয়েছিল সামরিক জান্তার হাতে গড়া রাজনৈতিক দলকে। সেই সখ্যতা এখনো অটুট আছে। জানি না হয়তো এজন্য শেখ হাসিনাকে সইতে হবে জাতীয় পার্টিকে পুর্নবাসন করার সমালোচনা। কারণ গণআন্দোলনে পতিত সামরিক স্বৈরাচার এইচ এম এরশাদ মৃত্যুও বরণ করেছেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে, আর সেসময়ও তার বিরুদ্ধে জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলা বিচারাধীন ছিল। শেখ হাসিনার জন্য এ এক বড় রাজনৈতিক কাটা, যার অন্যতম শাখা ২০১৪ সালের এক তরফা নির্বাচন।

যে আওয়ামী মুসলিম লীগ, নিজেকে সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত করতে নাম বদল করে আওয়ামী লীগ হলো। যে দলের নেতা জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে যুক্ত করে স্বাধীনতার একবছরের মধ্যে সংবিধান দিল। সেই দলের সভাপতি শেখ হাসিনা সামরিক সরকারের করা রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানে রেখে দিলেন। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া যার জন্য কঠিন, কঠিন বাস্তবতায় যিনি হেফাজতে নিয়েছেন উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠিকে, হয়তো তা জঙ্গীগোষ্ঠীকেই নিয়ন্ত্রণের কৌশলও, তবুও তা সমালোচনারই বিষয়।

অনেকেই এজন্য জননত্রেী শেখ হাসিনাকে ‘নীলকণ্ঠ’ বলতে চান। দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার রাষ্ট্রপরিচালনা করুক, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা স্বস্থিতে থাকুক, রাজনৈতিক সংঘাতের বদলে উন্নয়নের ধারা থাকুক চলমান-এই কি বঙ্গবন্ধু কন্যার কৌশল। সেজন্যই কি যেসব বামপন্থীরা এক সময় আওয়ামী লীগের তুলাধুনা করতো, বা বিরোধীতার ডুগডুগি বাজাতো তাদেরকেও সাথে রাখছেন তিনি। এমনকি যে জাসদ বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি রচনা করেছিল বলে বলছেন আওয়ামী লীগ নেতারাই, সেই জাসদের দুজন নেতাকেই মন্ত্রীত্বের পদ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সত্যিই ‘নীলকণ্ঠ’ রাজনীতিক শেখ হাসিনা।

এ কথাটি প্রযোজ্য দেশের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির ক্ষেত্রেও। ব্যক্তিগত ভাবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অপবাদ এমন কি তার ঘোর শত্রু দিতে পারবে না। কিন্তু দেশে যে দুর্নীতি বাড়ছে তা অস্বীকারের উপায় নাই। সেজন্যই হয়তো ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্সের’ কথা বলা হয়েছিল। সে মতে কিছু ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু হলেও বর্তমানে তা অনেকটাই হাল্কার ওপর ঝাপসা ভাবে চলছে। অনেক কিছুই কি সহ্য করে যেতে হয় অধিক সময় সরকারে টিকে থাকার জন্য? যদি ৭৫ বছর বয়সী সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার একটি সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ হয়, এই প্রশ্নটিই করবো তাকে সাহস করে। যার থেকে সাহস শিখেছি, ঈশ্বরদিতে ট্রেনে গুলির সময়, মিরপুর উপনির্বাচনে, চট্টগ্রামে লালদীঘিতে গোলাগুলি বা স্পিডবোটে কুতুবদিয়া চ্যানেল পাড়ি দেয়ার সময়। একযুগ এক নাগাড়ে রাষ্ট্র পরিচালনার পরও যিনি এখনো অনেক সাংবাদিকের কাছে ‘প্রিয় আপাই’ রয়ে গেছেন। গণভবনে গেলে যারা র্নিদ্বিধায় সেলফি তুলতে দাঁড়িয়ে যান সরকার প্রধানের পাশে। ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে নিজেকে মানবিক সরকার প্রধান সর্বশেষ মানবিকতা দেখিয়েছেন প্রতিপক্ষ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, হাইকোর্টে দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পরও মানবিক বিবেচনায় কারাগারের বাইরে বাড়িতে থাকার সুযোগ দিয়েছেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনা কিন্তু কেউই ভুলে যায়নি।

শেখ হাসিনা শুধু রাজনীতিতেই নন, সফল হয়েছেন অর্থনৈতিক বিবেচনাতেও। আর্থিক খাতের নানা কেলেঙ্কারির উদাহরণ দেয়া যেতেই পারে। কিন্তু মাথাপিছু আয় বেড়ে যাওয়া, রির্জাভ সর্ব্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছানোর রেকর্ড, দেশের প্রায় শতভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানো (সঞ্চালন লাইনের অবস্থা যদিও খারাপ), দেশকে পারমানবিক বিদ্যুৎ ও স্যাটেলাইট ক্লাবের সদস্য করার সাফল্য কেউ অস্বীকার করবে না, যদিও এসব নিয়ে সমালোচনারও শেষ নেই। কিন্তু বছরের প্রথম দিনে শিশু-কিশোরদের মুখে হাসি ফোটানোর বিনামূল্যে বই বিতরনের সফল কর্মসূচী সারাবিশ্বের জন্যই এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। সস্তার মোবাইল ফোনে এসএমএসে গরীব নারীর বিধবা ভাতা বা কিশোরীর হাতে উপবৃত্তির টাকা পৌঁছানোর কথা কে ভেবেছিল? সশস্ত্র বাহিনীর জন্য ফোর্সেস গোল ঠিক করা আর সে লক্ষ্যে দেশে নতুন একাধিক সেনানিবাস, মিগ-২৯ বা নৌবাহিনীর ফ্রিগ্রেট ও সাবমেরিন সংযোজন করেছেন চারবারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শেখ হাসিনা। সবশেষ করোনা মহামারিতেও অথর্নীতির চাকা সচল রেখে জিডিপির ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার কৃতিত্ব শেখ হাসিনা দাবি করতেই পারেন। যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নানা অব্যবস্থাপনায় বারবার বিব্রত তিনি। যিনি বিশ্বের অনেক দেশকে পেছনে ফেলে করোনার টিকাদানের ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিলেন।

ঢাকায় যেমন মেট্রোরেল, চট্টগ্রামের মানুষ তেমনি অপেক্ষায় আছে কর্ণফুলি নদীর তলদেশের বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধনের জন্য। খুলনার মানুষ অধীর অপেক্ষায় আছে পদ্মাসেতু দিয়ে চারঘণ্টায় ঢাকায় আসার জন্য। মঙ্গার অপবাদ ঘুচেছে উত্তরাঞ্চলে, আগাম বন্যায় তলিয়ে যাওয়ার আগেই হাওড়ের ধান কাটা হয়ে যাচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির হারভেস্টার মেশিনে, সরকারি ভর্তুকিতে যার সুফল পাচ্ছে দেশের কৃষক। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ ভুলে গেছে খাদ্য উদ্বৃত্তের বাংলাদেশ। মুক্তিযোদ্ধারা আজ উদ্বেলিত ‘শেখের বেটির’ জন্য। মেডেল ঝুলিয়ে তারা ভাতা তুলছেন। আর তাদের পোষ্যদের জন্য চাকরির কোঠা রাখায় সমালোচিত হচ্ছেন শেখ হাসিনা। সহ্য করছেন তিনি, যিনি নিজের লেখা প্রবন্ধের শিরোনাম দেন ‘সহে না মানবতার অবমাননা’। ৭৫তম জন্মদিনে তাই অভিবাদন নীলকণ্ঠ শেখ হাসিনাকে।

প্রণব সাহা

সম্পাদক, ডিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত