ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৮ মিনিট আগে
শিরোনাম

গুপ্ত কুঠুরি: সতর্কতাই প্রতিষেধক

  মোস্তফা কামাল পাশা

প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২১, ১৬:২৩

গুপ্ত কুঠুরি: সতর্কতাই প্রতিষেধক

প্রচার-প্রসার-খ্যাতির স্বাদ বড্ড তেতো, খাট্টাও! বাক্যটি ঠোঁট গলিয়ে বের হলেই পাগলের অট্টহাসি আর ভেড়ার ভ্যা-ভ্যা ভেঙচিতে কুম্ভকর্ণ এক লাফে ধুদ্দাপ উঠে পড়বেন! চোখ রগড়ে দশ টনি গদা হাতে, দোষী ‘পাগল-ভেড়া’র মাথা চাটনি বানাতে ছুটবেনই।

বাস্তবে এমন কিছু বলা অসম্ভব। কর্পোরেট চাষের জমির ফসল আমি বা আমরা খাই না, খাই শতভাগ অর্গানিক! হয় নাকি, না হয় না। বিষয়টা ঠিক এমন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট বা প্রকাশিত লেখার লিঙ্ক যারা পড়েন, জানেন, এই বস্তুটা আসলে কী! একটু ঘাড়ত্যাড়া। কেউ আদর করে তারছেঁড়া বললেও সয়ে নিতে হবে। আসলে কারো কারো জীবন রেললাইনের মতো এক সমান্তরালে চলে না। একটু ওলট-পালট হয়ে যায়। তাই ছা'পোষা আপোষকামী ভদ্রলোকের ভিড়ে উল্টো দৌড় বড্ড চোখে লাগে। সরকারি বড় চাকরি বা অর্থকরি সংস্থায় কর্তা ভজানো দায়িত্ব বড়ই মধুর। ব্যতিক্রম ছাড়া গাছের আগা থেকে তলা সব চেটেপুটে খাওয়া যায়। শুধু তাল-লয়-মাত্রা ঠিক রাখতে হয়। এরা নিজস্ব ভুবনে আরাম-আয়েশে ঘি, দুধ, মাখন খান, জাবরের ফেনাও ভাঙেন। আবার টানাটানির জীবিকায়ও মাঝে-মাঝেই উপরি আয়ে ভাঙা চেহারায় সিঁদুরে ছোপ লাগে কারো কারো। যাদের কোনো জীবিকাই নেই, কিন্তু রাজনীতি বা অন্য কোনো প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের বিলবোর্ডের ছায়ায়, তারাতো সবকিছুরই মালিক। এরা সুখী-স্বচ্ছল হুঙ্কার সমৃদ্ধ বড় রাঘব বোয়াল। হুঙ্কারেই আলাদীনের চেরাগ দৈত্যটা সব হাজির করে দেয়। এদের জীবনও কমবেশি ওই রেললাইন, একই সমান্তরালে বয়ে যায়, মাঝে মাঝে টানেলও। কর্পোরেট বা আধুনিক সামন্ত প্রভুরা আপাতত বাদ। স্বল্পকথায় এটাই আমাদের জীবন-জীবিকার ছোট্ট নমুনাচিত্র। দূর্ভাগ্য কপাল দোষে নিজে দলছুট। বর্ণিত দলের একটাতেও নেই। ছিলাম, কিন্তু থিতু হওয়া যাইনি। কেন, বলা হয়েছে বেশ ক'বার। সমস্যাটা নিজের। সমাধানও নিজকে খুঁজে নিতে হয়েছে।

এবার গুপ্ত কুঠুরি খোলা যাবে। সামাজিক সাইটে বন্ধু ও অনুসারি অনেক। কিন্তু সাথে ডজন, দেড় ডজন মাত্র। স্বাভাবিক, তুষ্ট করার দায় নেই, প্রশংসা লাভের অণুমাত্র গুণ নেই। সেলেব্রিটিও না। লিখিও উল্টাপাল্টা! তো কেন থাকবেন! তাই সই। জানেন কেউ কেউ, আমার ছেলেও তিন, নাতিও আপাতত তিন। ছেলেরা দেখতে আমার উল্টো, ‘হী ম্যান হিরো’! নাতিরাও আদরকাড়া। নাতি মেয়ে ও দু'ছেলের ঘরে। মেয়েরটা বড়, জন্মদিন গেল ১০ অক্টোবর। ও ট্রিপল থ্রি প্লাসের বিরল জাতক। অর্থাৎ জন্ম হয়েছে ১০-১০-'১০ সালের রাত দশটায়! দুঃখটা এখানেই। জন্মদিন আয়োজনের ছবি বা ক্লিপ সোসাল মিডিয়াায় দেয়া যায় না। এই মাধ্যমে প্রায় বছর চার থেকে সক্রিয়। শুরুতে হাল্কা কিছু হয়তো দিয়েছি। নিজেও কোনো বিশিষ্টের সাথে ছবি তুলি না। পারিবারিক আয়োজন প্রকাশ্যে টানতেও অস্বস্তি। নাতি আরিচ আরহাম (নাম মেয়ের শ্বশুরপক্ষের বাছাই, অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ) চতুর্থ গ্রেডে পড়ে। বেশ চটপটে ও বুদ্ধিমান। আমার শিক্ষকও! উচ্চারণের ভুল শুধরে দেয়। বেশ বড় হয়েছে, অনেক কিছু জানেও, বলা বারণ। প্রচারের বাইরে থাকাটা অভ্যাস। পরিবারের অন্য সদস্যরাও। বড় এক সমস্যা তৈরি হয়, বছর দেড় আগে। বড় ছেলে উপল, বউমা শিমুল দম্পতির ছেলে আইয়ান ইফরাজ। ওর মরহুম নানা কাজী আবু তাহেরের পছন্দের নাম। নিজে নীল ডাকলেও অন্যরা নয়। বছর দেড় আগে অ্যাপার্টমেন্ট করিডরে হুডি গাড়িতে ওর কিছু ছবি নিই। তখন ওর বয়স সোয়া বছর মাত্র। ও এখন বড়, খেলার সাথি ও ‘লাফিং বোম্ব’ও! ও’সময় ডজনখানেক ছবির অ্যালবামের একদম শেষে নাতির অ্যাকশন টাইপ একটা ছবি পোস্ট দিই (জুড়ে দেয়া ছবি)। ঘণ্টার মাঝে এটাতে অসংখ্য লাইক/কমেন্ট পড়ে। অ্যালবাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ছবিটি। এরপরেই ঘটে ঘটনা। ঢাকা থেকে একটি নামী বিজ্ঞাপনী সংস্থার পরিচিত ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ফোন দেন। ওদের নিয়মিত ক্লায়েন্ট একটি বহুজাতিক অথবা দেশি কর্পোরেট নতুন শিশুখাদ্যের সাপ্লিমেন্ট বাজারে ছাড়বে। ওটার বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল আমাকেই করতে হবে। সাথে নাতিকে বানাবে মডেল। নিশ্চিত লোভনীয় অফার। উল্লেখ্য যে, জীবন-জীবিকার কঠিন যুদ্ধে অনেক ঘাট-অঘাটে গুতোগুতি করতে হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল তারকা হোটেল গোষ্ঠীর পর্যটন, হোটেল ও সংশ্লিষ্ট সেবাভিত্তিক বিশেষায়িত 'TOURISM INTERNATIONAL' নামের বিশেষায়িত ইংরেজি মাসিকটি ২০০০ সাল থেকে আমার সম্পাদনায় বের হতো। পদবি ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হলেও উৎপাদনসহ সব দায় নিজের। দেশের তারকা হোটেল গ্রুপের সভাপতি হোটেল আগ্রাবাদ-এর সিইও এএইচএম হাকিম আলী এটার সম্পাদক। তিনি দেশ-বিদেশের বড় বড় চেইন হোটেলের মাসিক সব ইভেন্ট বাছাই করে দিতেন। সম্পাদনাসহ সংশ্লিষ্ট অন্যন্য খবর নিজের উদ্যোগে যোগাড় হতো। ইংরেজি সাংবাদিকতার পেশাদারিত্বে এশিয়ার অন্যতম অভিজাত একটি দৈনিকেব মাধ্যমে গত শতকের শেষ দশকের অন্তিমে শুরু হলেও খুব বেশি কাজের সুযোগ হয়নি। চাহিদা ও বাধ্যবাধকতা পূরণে ব্যর্থ ছিলাম। বিদায় নিতে হয়, বছর দুই পর। তাই প্রথম ‘গেটওয়ে বা বড় ব্রেক থ্রু’ বলতে হয়, এই দায়িত্বকে। শুরুতে কিছু জড়তা ছিলই। অবশ্য দ্রুতই কাটিয়ে উঠেছি। ওয়ান/ইলাভেনের তত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদে হোটেল ও পর্যটন ব্যবসায়ে হঠাৎ ধ্বস নামায় পত্রিকার বাজেট সংকুচিত করে দেন কর্তৃপক্ষ। বাজেট ঘাটতির জেরে ২০০৭ সালের মাঝামাঝি দায়িত্ব ছেড়ে দিই।

বিশেষায়িত সেক্টরের সাংবাদিকতা সামনে আরও কিছু নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। এর একটি ভিজুয়াল বিজ্ঞাপনের আইডিয়া ও জিঙ্গেল লেখা। ভাড়াটে লেখক হিসেবে কয়েক প্রভাবশালীর নামে ইংরেজি, বাংলায় 'কিতাব' রচনাও করেছি। নৈতিকতায় কী বলে জানি না। কিন্তু চুরি, বাটপারিতো আর না। যুদ্ধ আর প্রেমে সব জাহেয হলে বাঁচার জন্য শ্রম বিনিয়োগ নয় কেন? ওসব বেশ ক’বছর ধরে বন্ধ। দরকার হয় না, মন থেকে সমর্থনও পাই না। এখনো টিভিতে সম্ভবত কিছু বিজ্ঞাপন চলছে। পুরানো সূত্র ধরেই নাতিকে নিয়ে নতুন আবদার! প্যাকেজ অফারটাও ছয় অঙ্কের লোভনীয় ফিগার। সরাসরি না করে দিই, কারণ দিনমজুরির স্তর টপকে এসেছি। নাতিকে কোনো বিজ্ঞাপন সর্বস্ব মানহীন পণ্যের (শিশুখাদ্য সাপ্লিমেন্ট) মডেল করার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু তিনি ছাড়েন না, লেগে থাকেন বেশ ক'দিন। শেষে বাধ্য হয়ে অপ্রিয় সত্যের ঝাঁপি খুলি। আসলে যেসব বহুজাতিক বা কর্পোরেট বিদেশি পণ্য ও মুখরোচক খাবার মোড়কজাত বা প্রস্তুত করে ওগুলোর উৎপাদন খরচের ৬৫/৭০% বাজেট বিজ্ঞাপন, প্রচার ও প্যাকেজিং খাতে হজম হয়। বিজ্ঞাপন নির্মাতারা ডিসপ্লে কিউরিতে ওসব পণ্য সাজিয়ে রাখলেও নিজেরা এমন কী মডেল বা কর্মীরা পর্যন্ত ভুলেও ব্যবহার করেন না। চিত্রটা কাছ থেকে দেখা। বহুজাতিক বা কর্পোরেটের জনসংযোগ টিমকে খুশি করতে কোন মডেল তাদের সামনে ব্যবহারের মহড়া দিলেও দ্রুত ওয়াসরুমে ঢুকে ঘটান অন্য ঘটনা! এবার বুঝুন, রঙ ফর্সা বা বাচ্চাদের হ্নষ্টপুষ্ট করাসহ হরেক সাপ্লিমেন্ট ও মুখরোচক প্যাকেট খাদ্যের নামে আমরা কী খাচ্ছি বা প্রিয়জনদের খাওয়াচ্ছি! কোন পণ্যের নাম বলা সম্ভব না, কারণ বিজ্ঞাপনী চটকই মানুষকে সার্বক্ষণিক বোকা বানাচ্ছে। দায়তো অল্প হলেও নিজের আছেই। রাষ্ট্রীয় তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে মন্তব্যেও অরুচি। এবার বলুন, কীভাবে কী? নাতি ও পরিবারের সদস্যদের লুকিয়ে রাখা ছাড়া বিকল্প উপায় কী! নিজের পেশাগত ঘোরাঘুরি, ওড়াওড়ির কোন ছবিও পারতপক্ষে দেই না। কারণ ওগুলোর যেমন পণ্য মূল্য আছে তেমনি প্রাইভেসিও। ঘরের কিউটসহ এতসব আড়ালে রাখলে কিভাবে প্রচারের আলো গায়ে লাগবে?

আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যথেচ্ছ ও বহুল প্রচারের বিপদও প্রচুর। স্বল্প সময়ের মাঝে কিছু কাছের মানুষও অপ্রত্যাশিত বিপদে পড়েছেন। কৌশল, তদবির ও প্রভাবের জোরে রক্ষা পেলেও জের টানতে হচ্ছে। এখানে কে কোন ফন্দিতে কীভাবে আপনাকে ফাঁসাবে বুঝা খুবই মুশকিল। নিজে বিপদে পড়ার আগে সামান্য আঁচ করাও একদম অসম্ভব। তাই, সোসাল মিডিয়ার সতর্ক ব্যবহার ও সচেতনতাই আগাম প্রতিষেধক।

মোস্তফা কামাল পাশা, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • পঠিত