ঢাকা, রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

ছয় দফা কর্মসূচি: বাঙালি জাতির এক অলিখিত মুক্তির সনদ

  মো. আনারুল ইসলাম

প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২১, ১১:৪৩

ছয় দফা কর্মসূচি: বাঙালি জাতির এক অলিখিত মুক্তির সনদ

১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির পর যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার কাঠামোর আদলে পাকিস্তান নামের যে রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হয় তার প্রথম ভুল ছিলো ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা। পূর্ব পাকিস্তান ছিলো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হাজার মাইল দূরে আর বৃহৎ ভারত দ্বারা বিচ্ছিন্ন। কথা ছিলো নতুন স্বাধীন দেশ ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন দ্বারা পরিচালিত হবে এবং অচিরেই একটি গণমুখী সংবিধান প্রণয়ন করে সেই সংবিধানের আলোকে একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা হবে।

অথচ পাকিস্তানের প্রথম সরকার গঠন করতে এবং সংবিধান প্রণয়ন করতে প্রায় ১০ বছর সময় লেগে গেলো। ১৯৫৪ তে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করা হলেও তা কয়েক দিনের মধ্যেই ভেঙে দেওয়া হয়। ১৯৫৮ সালে জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা সামরিক শাসন জারি করে। ফলে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির অধিকার ভূ-লুণ্ঠিত করা হয়। উপরন্তু ১৯৫৯ সালে আইয়ুব খান কর্তৃক যে মৌলিক গণতন্ত্র চালু করা হয় তা ছিলো সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও অগণতান্ত্রিক। পাক ভারত যুদ্ধের পটভূমিতে পূর্ব পাকিস্তান এতটাই অরক্ষিত ছিলো যে, এটা দখল করা ছিলো ভারতের সামান্য সময়ের ব্যাপার। হয়তো সৃষ্টিকর্তার অপার রহস্যে ভারতের মনোযোগ পশ্চিম সীমান্তে আবদ্ধ ছিলো।

পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে বাঙালি জাতির অধিকার ছিলো সীমিত ও সংরক্ষিত। ৬৬ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর মধ্যে ২২ জন বাঙালি হলেও তারা কোনো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন না। আর যদি অর্থনৈতিক পটভূমির দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয় তাহলে সহজেই দেখা যায় যে আমাদের ৬০ ভাগ আয় হওয়া সত্ত্বেও তার ন্যায় সংগত বণ্টন নিশ্চিত করা হয়নি। সকল ক্ষেত্রে অর্থনীতির এই বণ্টন ছিলো বৈষম্যমূলক ও প্রতারণামূলক। আর সে জন্য ১৯৬৬ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত ৬ দফা দাবি ছিলো সম্পূর্ণ ন্যায্য, যৌক্তিক ও বৈধ।

৬ দফা কর্মসূচি:

১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে তৎকালীন বিরোধী দলগুলোর যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অধিকার হিসেবে ৬ দফা দাবি পেশ করেন।

১ম দফায় তিনি বলেন, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে পাকিস্তানে একটি সত্যিকার যুক্তরাষ্ট্র গঠন করতে হবে। এ যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার হবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির। প্রাপ্তবয়স্কদের সার্বজনীন ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নিয়ে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সার্বভৌম আইনসভা গঠিত হবে।

২য় দফায় বলা হয়, দেশ রক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হাতে রেখে অবশিষ্ট দায়িত্ব প্রদেশের হাতে দিয়ে দিতে হবে।

৩য় দফায় বলা হয়, দেশের দুই অঞ্চলের জন্য হয় সহজে বিনিময়যোগ্য দুটি ভিন্ন মুদ্রা প্রচলন করতে হবে না হয় একই মুদ্রা থাকলে তার পাচার রোধে শাসনতন্ত্রে ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং হিসাবের স্বচ্ছতার জন্য দুই অঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকতে হবে।

৪র্থ দফায় বলা হয়, সকল প্রকার কর; খাজনা ও শুল্ক ধার্য করার ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রাদেশিক সরকারের আয়ের একটি ধার্যকৃত অংশ যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে প্রদান করা হবে। এ বিষয়ে রিজার্ভ ব্যাংক সমূহ শাসনতন্ত্র অনুযায়ী বিধান তৈরি করবে।

৫ম দফায় বলা হয়, বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে প্রদেশসমূহের হাতে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। এই সংশ্লিষ্ট খাত থেকে আয়কৃত অংশের যৌক্তিক পরিমাণ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহের জন্য জমা করা হবে।

৬ষ্ঠ দফায় বলা হয়, জাতীয় নিরাপত্তার পাশাপাশি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও সংহতি জোরদার করতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি আলাদা আধাসামরিক বাহিনী বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন করতে হবে।

ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণার পর বাঙালি জাতির মধ্যে এক নতুন উদ্দীপনা জাগ্রত হয়। অন্যান্য প্রদেশগুলোও তাদের প্রতিক্রিয়া জানায় এবং অধিকাংশ প্রদেশ তাতে সমর্থন দেয়। ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারির সম্মেলনে ৬ দফা কর্মসূচি গৃহীত হয় এবং কয়েক দিনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ ও অঙ্গসংগঠন তা অনুমোদন দেয়। ফলে বাঙালি জাতি এই দাবিগুলোকে তাদের মুক্তির পূর্বাভাস হিসেবে দেখতে থাকে। অপরদিকে পাকিস্তান সামরিক সরকার ৬ দফা কে ষড়যন্ত্র, বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব ও রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। পাকিস্তান সরকার তাদের প্রচার যন্ত্র ও গণমাধ্যমে ৬ দফার বিরুদ্ধে বিষোদগার চালাতে থাকে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কৃষক, মজুর ও বিভিন্ন পেশাজীবীরা এ দাবিগুলোকে স্বাগত জানায়। ৬ দফা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার জন্য নতুন স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে।

তৎকালীন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে ৬ দফা দাবি শুধু দাবিই ছিলো না, এগুলো ছিলো পাকিস্তানি দুঃশাসন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। ২৩ বছরের বর্বর শঠতা পূর্ণ শাসনের ঘোর অমানিশা ও দাসত্ব থেকে বাঙালি জাতিকে টেনে তুলে আনতে ৬ দফা দাবি ছিলো অন্ধকার রাত শেষে ভোরের আলো বিচ্ছুরিত হওয়ার মত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, এ দাবিসমূহ আদায় হলে পূর্ব পাকিস্তান শুধু স্বায়ত্তশাসনই অর্জন করতো না, স্বাধীনতা শব্দটি ছাড়া আর সকল বৈষম্যেরই বিলুপ্তি ঘটতো। আর এ জন্যই ৬ দফাকে বাঙালি জাতির মুক্তির এক অলিখিত সনদ বলা হয়।

৬ দফার অজুহাতে পাকিস্তানের সামরিক সরকার ৩ বছর বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে বন্দী রাখার কুট কৌশল করে। ফলে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচনে জয়লাভ করেও সরকার গঠন করতে না দেওয়ায় চূড়ান্ত স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ সালের মার্চের গণ ডাক ইত্যাদি ঘটনাবলী তৈরি হয়। আর সর্বশেষ পরিণতি হিসেবে আসে সেই বহুল প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা। ঘটনাগুলোর পারস্পরিকতা ও উৎস সন্ধান করলে এটা সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে ভাষা আন্দোলন থেকে ৫৪ এর নির্বাচন হয়ে ৬৫ এর পাক-ভারত যুদ্ধ পর্যন্ত ছিলো ৬ দফা কর্মসূচির পটভূমি। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে স্বাধীনতার যে বীজটি রোপিত হয়েছিলো, ১৯৬৬ এর ৬ দফায় তা অঙ্কুরিত হয়েছিলো এবং ১৯৭১ এর মুক্তিসংগ্রামে তা ফলপ্রসূ হয়।

বাঙালি জাতির সেই অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর দেশপ্রেম, সচেতন চিন্তা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ফল হিসেবেই সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে মাত্র ২৩ বছরে সফলতা এনে দেন। পৃথিবী যতদিন টিকে থাকবে বিশ্ব মানচিত্রে লাল-সবুজের সোনার বাংলা ততদিন বাঙালির সেরা এই রাজনৈতিক নেতাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে যাবে এটাই হোক আজকের আলোচনার মূল প্রত্যাশা।

তথ্যসূত্র:

১. ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন (২০১৬), স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনী, ঢাকা।

২. ড. মোহাম্মদ আব্দুল ওদুদ ভূঁইয়া, বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন, আজিজিয়া বুক ডিপো, ঢাকা।

৩. ড. হারুন অর রশিদ (২০১৮), বাংলাদেশের রাজনীতি, সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন (১৭৫৭-২০১৮), অন্য প্রকাশ ঢাকা।

৪. অলি আহাদ (১৯৮২), জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫, খোশরোজ কিতাব মহল, ঢাকা।

লেখক: প্রভাষক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত