ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়: বাংলা কথাসাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিভা

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:৪১  
আপডেট :
 ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০:৫৬

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়: বাংলা কথাসাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিভা
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

বাংলা উপন্যাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাঙালি কথাসাহিত্যিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। প্রভাতকুমার বিশেষ সিদ্ধি অর্জন করেছিলেন ছোটোগল্প-রচনায়। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের পরেই তার স্থান স্বীকৃত হয়েছিল। তিনি বাস্তব পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, কিন্তু তার গভীরে প্রবেশ করেননি, এমন কথা বলা হয়ে থাকে। তবে দেশ ও বিদেশের পটভূমিকায় তিনি বহু ঘটনা ও চরিত্র এমনভাবে স্থাপিত করেছেন যাতে তারা প্রাণের স্পর্শ লাভ করেছে। সরল,অনাবিল হাস্যরসের গল্প লেখক রূপেই সমধিক প্রসিদ্ধ | কেরানি থেকে হন ব্যারিস্টার,পরে পত্রিকা সম্পাদক এবং শেষ জীবন কাটে অধ্যাপনায় | সম্পাদিত পত্রিকার নাম মানসী ও মর্মবাণী | চৌদ্দ বছর ধরে পত্রিকাটি সুষ্ঠভাবে চালিয়েছেন |

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৩ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার ধাত্রীগ্রামে মাতুলালয়ে। তার পৈতৃক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার গুরাপ গ্রামে। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে প্রভাতকুমার জামালপুর হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং পাটনা কলেজ থেকে এফ.এ ও ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে বি.এ.পাশ করেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে আইন পড়তে বিলেত যান এবং ব্যারিস্টারি পাশ করে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফেরেন। তখন থেকেই ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দার্জিলিং, রংপুর, গয়া প্রভৃতি স্থানে আইন ব্যবসায় নিযুক্ত থাকেন। নাটোরের রাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়ের উৎসাহে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে মানসী ও মর্মবাণী পত্রিকার সম্পাদনা করতে শুরু করেন। পরে এই মহারাজেরই প্রচেষ্টায় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এখানে অধ্যাপনায় লিপ্ত থাকেন।

ছাত্রাবস্থায় 'ভারতী' পত্রিকায় কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে প্রভাতকুমারের সাহিত্য জীবনের শুরু। পরে গদ্য রচনায় হাত দেন। 'শ্রীমতী রাধামণি দেবী' ছদ্মনামে লিখে কুন্তলীনের প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। এক বার 'শ্রীজানোয়ারচন্দ্র শর্মা' ছদ্মনামে তার রচিত নাটক 'সূক্ষ্মলোম পরিণয়' মর্মবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রদীপ, প্রবাসী ও ভারতী পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। তার রচিত ১৪ টি উপন্যাস ও মোট ১০৮ টি গল্প নিয়ে ১২ টি গল্প-সংকলনের সম্ভার আছে বাংলা সাহিত্যে। তার প্রথম উপন্যাস 'রমাসুন্দরী' ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ধারাবাহিক ভাবে 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত 'রত্নদীপ'। এটি নাট্য ও চলচ্চিত্ররূপে জনপ্রিয় হয়েছে। সরল ও অনাবিল হাস্যরসের গল্পলেখক হিসাবে প্রভাতকুমার সমধিক প্রসিদ্ধ। সাধারণ আটপৌরে জীবনের লঘু ও দুর্বল দিকগুলো হাস্যরসে পরিবেশিত হয়েছে। বাঙালি জীবনের সুখ ও দুঃখের জীবন দোলার ছন্দে ছন্দময় হয়ে সার্থক হয়েছে। তার লেখা গল্প পড়ে রবীন্দ্রনাথ অভিভূত হয়ে এক চিঠিতে তাকে লিখেছিলেন -

"তোমার গল্পগুলি ভারি ভালো। হাসির হাওয়ায় কল্পনার ঝোঁকের পালের উপর পাল তুলিয়া একেবারে হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিতেছে, কোথাও কিছুমাত্র ভার আছে বা বাধা আছে তাহা অনুভব করিবার জো নাই।"— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য ছিলেন। সাহিত্যজীবনের শুরুতে প্রভাতকুমার কবি হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথই তাকে গদ্য লিখতে উৎসাহিত করেন। দুজনে বাংলাসাহিত্যে সমকালীন হলেও রবীন্দ্রনাথ মূলত কবি আর প্রভাতকুমার সফল ও দক্ষ গদ্যকার। রবীন্দ্রনাথের বেশিরভাগ ছোটগল্পগুলো যেখানে কল্পনাপ্রসূত, প্রভাত কুমারের লেখা সেখানে বাস্তবসত্যে নিষ্ঠাবান। প্রভাতকুমার তার গল্পে ভাব-উচ্ছ্বাস হ্রাস করে তুলে ধরেছেন বাস্তবসত্যকে। যা মানুষের দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করেছেন নিজের শৈল্পিকগুণে তুলে ধরেছেন পাঠকের কাছে। অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য "প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠগল্প'' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন -

"রবীন্দ্র-কবিমানসের স্বমন্দাকিনীই ছোটগল্পে মর্ত্যভাগীরথীরূপে মানুষের কাছে আনন্দ-বেদনায় কলনাদিনী, তাই তার পাবনপ্রবাহে মৃৎপুত্তলিকাও ক্ষণে ক্ষণে দেবতার অমর মহিমায় দীপ্তমান। প্রভাতকুমারের যমুনা মৃত্যু সহোদরা কালিন্দী, তার নির্মল জলে পার্থিব জীবনেরই স্বমহিমচ্ছায়া প্রতিবিম্বিত।"— অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য

সূক্ষ্ম জীবনবোধের কারণেই রবীন্দ্রনাথের কালে থেকেও বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পেতে প্রভাতকুমারের এতটুকু বেগ পেতে হয়নি। বিচিত্রমুখী গল্পের জন্য তিনি সমকালেই খ্যাত হয়েছিলেন ‘বাংলার মপাসাঁ’ নামে।

তার গল্পগুলি ইংরাজীতেও অনুদিত হয়েছে। তবে তিনি ছোটগল্পকার হিসাবে যতখানি সফল ঔপন্যাসিক হিসাবে ততটা নন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের স্কুল পাঠ্য হিসাবে কিছু রচনা, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ।

উল্লেখযোগ্য রচনাকর্ম

গল্প সংকলন :--

১) 'নবকথা' (১৮৯৯)

২) 'ষোড়শী' (১৯০৬)

৩) 'দেশী ও বিলাতী'(১৯০৯)

৪) 'গল্পাঞ্জলি' (১৯১৩)

৫) 'গল্পবীথি' (১৯১৬)

৬) 'পত্রপুষ্প'(১৯১৭)

৭) 'গহনার বাক্স ও অন্যান্য গল্প'(১৯২১)

৮) 'হতাশ প্রেমিক ও অন্যান্য গল্প' (১৯২৪)

৯) 'বিলাসিনী ও অন্যান্য গল্প'(১৯২৬)

১০) 'যুবকের প্রেম ও অন্যান্য গল্প'(১৯২৮)

১১) 'নতুন বউ ও অন্যান্য গল্প'(১৯২৯)

১২) 'জামাতা বাবাজী ও অন্যান্য গল্প'(১৯৩১)

উপন্যাস সমূহ :-

১) 'রমাসুন্দরী'(১৯০৮)

২) 'নবীন সন্ন্যাসী'(১৯১২)

৩) 'রত্নদীপ' (১৯১৫)

৪)' জীবনের মূল্য'(১৯১৭)

৫)'সিন্দুর কৌটা'(১৯১৯)

৬) 'মনের মানুষ'(১৯২২)

৭) 'আরতি' (১৯২৪)

৮) 'সত্যবালা '(১৯২৫)

৯) 'সুখের মিলন'(১৯২৭)

১০)'সতীর পতি'(১৯২৮)

১১)'প্রতিমা'(১৯২৯)

১২) 'বিদায় বাণী'(১৯৩৩)

১৩)'গরীব স্বামী'(১৯৩৮)

১৪) 'নবদুর্গা'(১৯৩৮)

অন্যান্য গ্রন্থ :-

'অভিশাপ'(ব্যঙ্গকাব্য)

কথাসাহিত্যিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৫ এপ্রিল, মাত্র ৫৯ বছর বয়সে প্রয়াত হন ।

বাংলাদেশে জার্নালা/এমএস

  • সর্বশেষ
  • পঠিত