ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির অনুপ্রেরণা

  মোহাম্মদ ইলিয়াছ

প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২২, ১৮:৫৬

৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির অনুপ্রেরণা

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার যাদুকরি মন্ত্রে উজ্জীবিত করে। কোনো ধরনের সমঝোতা বা আপেসের পথে না গিয়ে, সমস্ত রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর মনোমোহিনী আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ৩০ লাখ মানুষ জীবন উৎসর্গ করে। যা মানব ইতিহাসে কালজয়ী ও নজিরবিহীন।

৭ মার্চের অন্যতম দীপাধার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নেতৃত্বের সর্বোচ্চ দেশপ্রেম, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির এবং লক্ষ্য অর্জনে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন -শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি। এ ভাষণের আরকটি দিক হলো, এটি সময়ের পরিক্রমায় আবদ্ধ না থেকে কালোত্তীর্ণ ও নবোদিত একটি মোহমুগ্ধ প্রেরণা। এ ভাষণের আরকটি ইতিবাচক দিক হলো এর কাব্যিক গুণ- শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাস। যা হয়ে ওঠে শ্রুতিমধুর, গীতিময়ী ও ঔজ্জ্বল্য অনুপ্রেরণা।

যে কেনো শ্রেষ্ঠ ভাষণেই উত্থিত হয় সাম্প্রতিক বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে, ফলে তা তাৎক্ষণিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও হৃদয় থেকে নিঃসৃত বলা যায়। জাতির পিতার এ কালজয়ী ভাষণও ছিল তাই। যা কোনো পূর্ব পরিকল্পিত সাজানো-গোছানো গতানুগতিক বাকসর্বস্ব লিখিত বক্তব্য ছিলো না। এ ভাষণের অপর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি আকারে ছিল নাতিদীর্ঘ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উভয় স্তরে অসংখ্য ভাষণ ও বক্তব্য প্রদান করা হয়। তবে সকল ভাষণ বা বক্তব্য মানুষের হৃদয় নাড়া দিতে পারে না। এমনকি গুরুত্ব ও তাৎপর্যও এক রকম হয় না। যে ভাষণে অমানিশায় ডুবতে থাকা জাতি একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্দেশনা পায়। যাতে থাকবে দেশাত্মবোধ, আদর্শ ও স্বতন্ত্র জাতিস্বত্বা বিনির্মাণে উদ্বুদ্ধ হয়, এমনকি রক্তক্ষয়ী বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে বিজয়ের পতাকা নিয়ে বিশ্বের বুকে তুলে ধরতে পারে একটি মানচিত্র।

এমন ধরণের ভাষণেই ব্যতিক্রম ভাষণ হিসেবে বিবেচিত। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে দেয়া ভাষণ অনন্য ও সম্মোহনী। বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ, ক্ষুরধার, তেজস্বিতা,বাগ্মীতা, দৃঢ়তা, দূরদর্শিতা, সুদুরপ্রসারি চিন্তা, দ্বিগ্বিজয়ী, প্রসন্ন, পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টিতে সময়োপযোগী পরিশীলিত প্রয়োজনীয়তার নিরিখে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার সক্ষমতায় এ ভাষণ ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী।

এ ভাষণ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের আপামর বৃদ্ধ, যুবক, নারী-পুরুষ বণিতাকে একেই পতাকাতলে সমবেত করে। এ ভাষণই ছিলে বাঙালি জাতির পরোক্ষভাবে মুক্তির সনদ। স্বাধীনতা ছিল বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। তবে এ স্বাধীনতা একদিনে অর্জিত হয়নি। মহান ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জনের দীর্ঘ এ পথ পরিক্রমা ছিলো বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম সাহস, দেশপ্রেম, সীমাহীন ত্যাগ-তীতিক্ষা,বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, প্রতিস্বিক দিকনির্দেশনা জাতিকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সাথে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে লাখো জনতার বজ্রকণ্ঠে ১৮ মিনিটব্যাপী যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন তা আজও বিশ্বের ইতিহাসে শ্রুতিমধুর ও মর্মস্পর্শী হিসেবে সমাদৃত। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পরতে পরতে মিশে আছে জাতির পিতার অসামান্য অবদান। তাঁর অনুপমেয় বাগ্মীতা ও রাজনৈতিক সৃজনশীল প্রজ্ঞায় চীর ভাস্বর। ওই ভাষণে তিনি তৎকালীন পরিস্থিতি, বাঙালি জাতির আবেগ, স্বপ্ন ও অস্তিত্ব রক্ষা কে একসূত্রে গেঁথে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, যা ছিল মূলত পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ডাক।

৭ মার্চের ভাষণের রয়েছে দীর্ঘ আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বঞ্চনার ইতিহাস। ওই ভাষণ আমাদের প্ররণার চিরন্তন উৎস। বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার ওই ভাষণের দিক-নির্দেশনাই ছিল সে সময় বজ্রকঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমিত শক্তির উৎস ছিল এই ঐতিহাসিক ভাষণ। জাতির পিতার এ কালজয়ী ভাষণ ছিল মুক্তিকামী বাঙালির মোহিত মহাকাব্য। এ ভাষণে জাতির পিতার লড়াকু, সক্ষ্ণদর্শী ও স্বপ্নাদিষ্ট প্রতিভার স্ফূরণ প্রকাশ পেয়েছে। এ শোভিত ভাষণ পাল্টে দিয়েছে একটি দেশের মানচিত্র, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত। এ ভাষণে ছিল বহুমাত্রিকতায় বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। এ ভাষণ শুধু বাঙালি জাতির জন্যই নয়, এটি বিশ্বমানবতার ইতিহাসে শোষিত- বঞ্চিতদের অবিস্মরণীয়, অনুকরণীয় মহামূল্যবান দলিল।

ইউনেস্কোর সিদ্ধান্তে এটিই স্বীকৃত হয়েছে। গণতন্ত্র, সুখৈশ্বর্য মানসিকতা, ত্যাগ দেশপ্রমের উজ্জ্বল আদর্শ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম, জাতিভেদ - বৈষম্য ও জাতি নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্বমানবতার মুক্তির সংগ্রামে যুগে যুগে এ ভাষণ অনুপ্রেরণা জোগাবে। সাধারণ মানুষ, রাষ্ট্রনায়ক, সমরকুশলী কাছে এটি সম্মোহনী টনিক।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক (ইতিহাস), ৩১ তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)

বাংলাদেশ জার্নাল/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত