ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

জীবন সায়াহ্নে নারীর পুষ্টির বিকল্প নেই

  কামরুন-নাহার-মুকুল

প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২২, ১৫:৫৪

জীবন সায়াহ্নে নারীর পুষ্টির বিকল্প নেই

সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীর বাঁশীর হুইসেলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেট খুললেন ষাটোর্ধ্ব মিসেস আফসানা। গেট আর বন্ধ করতে পারলেন না; ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়েন। ডাক্তারি রিপোর্ট এলো অতিরিক্ত রক্তশূন্যতা; রক্তে হিমোগ্লোবিন কম; শরীরে পুষ্টির ঘাটতি।

প্রায় ১ লাখ ৪৮ হাজার ৪৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বর্তমান বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬৬ দশমিক ১৭ মিলিয়ন, সেখানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬২ দশমিক ৬ শতাংশ গ্রামে বাস করেন। গ্রামের ওই বিশাল জনসংখ্যার প্রায় ৫২ মিলিয়নই নারী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ি মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮.১ ভাগ অর্থাৎ ১৩.৪৬ মিলিয়ন প্রবীণ রয়েছেন তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক প্রবীণ নারী।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) পুষ্টি জরিপ- ২০১১ এর তথ্যানুযায়ী ৫০ শতাংশের বেশি নারীই পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নারীর পুষ্টিহীনতার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। যুক্তরাষ্টের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির বাংলাদেশের নারী ও শিশুস্বাস্থ্য-২০১১ শীর্ষক গবেষণায়, এ দেশে মায়েদের এক তৃতীয়াংশ অপুষ্টির শিকার। উচ্চতার তুলনায় তাদের ওজন কম। অথচ বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বড়ো ধরনের একাধিক পুষ্টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এসব প্রকল্পের কার্যক্রম সাফল্য পেলেও নারীদের পুষ্টিহীনতা কমছে না। সে অর্থে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি ছাড়া দেহ কাজ করতে অক্ষম। নিরাপদ পুষ্টিযুক্ত খাবার দেহের বৃদ্ধি ও পুষ্টিসমৃদ্ধি খাবার। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একজন নারীর স্বাস্থ্যরক্ষায় বয়ঃসন্ধিকালসহ সব বয়সে শরীরের প্রয়োজন অনুসারে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই নারীর পুষ্টিহীনতার হার কমে আসবে।

নারীর অপুষ্টির সূত্রপাত জন্মের আগে থেকেই। দরিদ্র পরিবারে নারীরা খাবার কম পান। ক্রয়সীমার মধ্যে নেই বলে সুষম খাদ্য গ্রহণ করা সম্ভবও হয় না। কম বয়সিদের তুলনায় প্রবীণদের খাবারের চাহিদা কিছুটা ভিন্ন। তাদের খাবারের তালিকায় প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার থাকা জরুরি। চিকিৎসক বিশেষজ্ঞদের মতে বয়স বাড়ার সাথে সাথে যেমন চুল পাকে তেমনি চল্লিশের ঘর পেরোলেই হাড় ক্ষয় হতে থাকে এবং দুর্বল হতে শুরু করে। মেনোপজের পর হাড়ের মধ্যে নতুন কোষ গঠনের ক্ষমতা কমে যায়। তখন ক্যালসিয়ামই রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে সাহায্য করে; হাড়ের নতুন কোষ গঠনে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম খাদ্য গ্রহণের পরেও শরীরে যদি ভিটামিন ডি’র অভাব থাকে, তবে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি’ সমৃদ্ধ খাবার প্রয়োজন। কেননা শরীরে ভিটামিন ডি’র অভাব থাকলে তা কোনোভাবেই কার্যকর হবে না।

ভিটামিন-ডি শরীরের অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান; যা শরীরের হাড় ও মাংসপেশীর জন্য একান্ত অপরিহার্য। হাড় ও দাঁত শক্ত করে; ক্ষয়রোধ করে। স্নায়ু, হৃদস্পন্দন ও মাংসপেশীর কাজেও লাগে। দেহে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি’র অভাব হলে অস্টিওপোরোসিস নামের রোগটি প্রধাণত: ৪০ বছরের ওপরের বয়স্ক নারীদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়। সামুদ্রিক মাছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ডি রয়েছে। অতি সহজেই রোদ থেকে ভিটামিন- ডি পাওয়া যায়। সূর্যের উপস্থিতিতে শরীরে ভিটামিন- ডি সংশ্লেষিত হয়। প্রতিদিন ১০ মিনিট সূর্যের রশ্মি শরীরে লাগালে ভিটামিন-ডি’র ঘাটতি পূরণ হয়। শরীরে আয়রনের অভাব হলে রক্তশূন্যতা বা অ্যানেমিয়ার সমস্যা দেখা দেয়। নারীদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা তীব্র। রক্তে আয়রনের অভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। ডিমের কুসুমে সবচেয়ে বেশি পুষ্টিকর উপাদান থাকে। এতে সবচেয়ে বেশি প্রোটিন ও হেলদি ফ্যাট রয়েছে; অধিক পরিমাণে ল্যুটিন, জ্যাক্সেন্থিনের মতো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে বলে চোখকে ভালো রাখে। চোখের ছানি ও অন্যান্য সমস্যা কমে যায়।

নারী শরীরের জন্য প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় নির্দিষ্ট পরিমান ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধ খাবার থাকা খুবই জরুরি। কেননা নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার এবং প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর খাবার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। ভিটামিন এর অভাবে অবসন্নতা ও বিষন্নতা দেখা দেয়, ওজন কমে যায়, স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়। কেবল দুধ খেলেই ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ হয় না। মাছ, মাংস, ডিম দুধে ভিটামিন পাওয়া যায়। তবে এর পাশাপাশি অন্য খাবারও প্রয়োজন। ব্রকলি, বাঁধাকপি, মাছের নরম কাঁটাও ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ করে। ব্লাড প্রেশার আর ডায়াবেটিসের মতোই হাঁটুর ব্যাথা বাঙালি পরিবারে জেঁকে বসেছে। হাড় ক্ষয়ের কারণেই নারীর শরীরে ব্যথা বাসা বাঁধে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত বিশেষ কিছু ব্যায়ামের মাধ্যমে এ রোগটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। ভালো ব্যায়াম সাঁতার কাটা। তাতে জয়েন্টের ওপর চাপ কম পড়ে কিন্তু মাংসপেশী শক্ত হয়।

নারীদের ক্ষেত্রে একটা বয়সের পর স্তন ক্যান্সারের প্রভাব দেখা দেয়। স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করার জন্য ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া খুবই জরুরি। লাল, হলুদ বর্ণের সবজি এবং ফলের উপকারিতা সব বয়সের মানুষের জন্য প্রয়োজন। প্রবীণ নারীদের ক্ষেত্রে ডিমেনসিয়া, আলঝাইমার রোগ প্রতিরোধে এ ধরনের পুষ্টি সাহায্য করে। ফল পুষ্টিসমৃদ্ধ ও রোগ প্রতিরোধকারী খাদ্য। ফলে আঁশ জাতীয় উপাদান থাকে বলে তা কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করে। ফলের রস সহজে হজম হয়; শরীরে কাজ করে তাড়াতাড়ি। প্রতিটি ফলেই কম বেশি পরিমাণ ভিটামিন ও খনিজ লবন থাকে। শুধু অসুস্থ হলেই নয় বরং প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় একটি করে পাকা ও টাটকা ফল আমাদের নিরোগ স্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবন দিতে পারে।

পুষ্টি পূরণে গ্রামীণ নারীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। পতিত জমি আর বসতবাড়ির আঙ্গিনায় কচু, মুলা, ডাঁটা, পুঁইশাক, গাজর, টমেটোসহ মৌসুমি শাকসবজি উৎপাদন করে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে আসছেন। যতক্ষণ শারীরিকভাবে চলাফেরায় সক্ষম থাকেন ততক্ষণ এ কাজে তাদের অবহেলা নেই। সুস্থ-সবলভাবে বেঁচে থাকতে পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নেই; পুষ্টিকর খাবার খেতেই হবে। এর চাহিদা পূরণে অচাষকৃত উদ্ভিদগুলো বেশি নিরাপদ। আর প্রাকৃতিক খাবারের উৎস্য অচাষকৃত উদ্ভিদ।

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক ২ শত গ্রাম শাক-সবজি খাওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের খালে-বিলে, পতিত জমি, বাড়ির আঙিনায় রয়েছে অচাষকৃত বাহারি রকমের উদ্ভিদ বৈচিত্র। হেলেঞ্চা শাক, ঢেঁকি শাক, নটে শাক, গিমা শাক, নুনিয়া শাক, থানকুনি, তেলাকুচা, বথুয়া, কলমিসহ নাম না জানা আরো অনেক। এ সকল উদ্ভিদই যুগ যুগ ধরে গ্রামীণ ও প্রান্তিক মানুষের অপুষ্টি দূরীকরণে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টির আধার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিনসহ অনেক পুষ্টি উপাদান রয়েছে, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়; খাবারে রুচি আনে, অথচ এ সবের নাম ও গুণ সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের সন্তানরা জানেই না। কাজের এ বিষয়ে সচেতনতা জরুরি। আর সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমসহ আমাদের সকলের নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। (পিআইডি ফিচার)

বাংলাদেশ জার্নাল/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত