ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

আধুনিক ক্রীতদাস চা শ্রমিক এবং মুজুরি বাড়ানোর আন্দোলন

  শওকত জামান

প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২২, ১৪:৩২  
আপডেট :
 ১৭ আগস্ট ২০২২, ১৫:২৭

আধুনিক ক্রীতদাস চা শ্রমিক এবং মুজুরি বাড়ানোর আন্দোলন

চা শিল্পের উন্নতি হলেও বদলাচ্ছে না চা শ্রমিকদের জীবন। শ্রম শোষনের শিকার হয়ে আসছে ব্রিটিশ আমল থেকে আজঅব্দি। সারদিন কাজের পর একজন চা শ্রমিকের আয় হয় ১২০ টাকা। দ্রব্যমুল্য পাল্লা দিয়ে বাড়লেও সেভাবে বাড়েনা তাদের বেতন। নেই নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক জাতিগত পরিচয়। লেখাপড়ার সুযোগ নেই। নেই স্যানিটেশন ব্যবস্থাও। রয়েছে চিকিৎসার অভাব। কাজ করতে গিয়ে অঙ্গহানি ঘটলেও কোনো সাহায্য নেই। ৭ ফুট বাই ১৪ ফুট ঘরে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতরভাবে বসবাস করতে হয়। ৫-৬ সদস্যের অনেক পরিবার আছে যেখানে ১ জন কাজ পাচ্ছে ১২০ টাকা আর বাকিরা এই টাকার উপর নির্ভর করেই দিন পাড়ি দিতে হয়। ছোট ভাঙাচোরা ঘরে থাকতে হয় গবাদি পশুসহ সন্তানদের নিয়ে। বাগান কর্তৃপক্ষের ঘর মেরামত করে দেয়ার কথা থাকলেও তা হয় না বছরের পর বছর। তাদের নেই নিজস্ব কোনো জায়গা। বাগানে কাজ না করলে থাকার জায়গা হারানোর ভয়। এভাবে নানা বঞ্চনা দু:খ্য দূর্দশার মধ্যে কাটছে বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের জীবন।

হতভাগ্য চা শ্রমিকদের ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৩০ এর দশকে সুন্দর জীবনযাত্রার লোভ দেখিয়ে এদেরকে বাংলাদেশে এনেছিল চা কোম্পানীর মালিকরা। কম দামে শ্রম কিনে অধিক মুনাফা অর্জন করার লক্ষ্যে ইংরেজ ব্যবসায়িরা আজীবন কাজের শর্তে চুক্তিবদ্ধ করে ভারতের বিহার, মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশ, ওড়িশা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে কানু, তেলেগু, লোহার, রবিদাস, গোয়ালাসহ প্রায় ১১৬টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিল। গাছ নাড়লে টাকা পাবে কিন্তু চা-শ্রমিকরা এ অঞ্চলে এসে দেখে, গাছ নাড়লে টাকা পাওয়া তো দূরের কথা; হিংস্র জীবজন্তুর প্রতিকূল পাহাড়-জঙ্গলময় পরিবেশে নিজের জীবন বাঁচানোই দুঃসাধ্য ব্যাপার। অনাহারে-অর্ধাহারে, অসুখে-বিসুখে এক বীভৎস জীবনের সম্মুখীন হয় তারা।

সে সময় আড়কাঠি ও গিরমিট প্রথার কারণে চা-ম্যানেজার এই অসহায় মানুষগুলোর ওপর একচ্ছত্র নির্যাতন করার অধিকার পায়। কোনো শ্রমিক ইচ্ছে করলেই চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে পারত না। বাগান থেকে পালিয়ে গেলে তাদের ধরে আনা হতো। দেয়া হতো অমানবিক শাস্তি যা অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো। চাবুক-বুটের-লাথি ছিল এই নিরীহ মানুষগুলোর নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এভাবে মালিকদের হাতে শ্রমিকের মৃত্যুকেও সাধারণ ঘটনা হিসেবে দেখা হতো। মালিকদের কথাই সেখানে রাষ্ট্রীয় আদেশ হিসেবে গণ্য হতো। শ্রমিকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলতে কোনো কিছু কল্পনাই করা যেত না। বাগানের ভেতরে ছাতা মাথায় হাঁটাও অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো। এদেশে আসার শুরু থেকেই তাদেরকপালে সুন্দর জীবনযাত্রার বদলে জুটেছে শুধু অবহেলা-নির্যাতন। এরা যেনো আজকের আধুনিক ক্রীতদাস।

বিট্রিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তানের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার এতো বছর পেরিয়ে গেলেও চা বাগানের শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আসেনি। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি তাদের জীবনযাত্রায়। এমনকী, মৌলিক অধিকারও তারা ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। নিজের অধিকার নিয়ে যেনো সোচ্চার না হতে পারে সেজন্য মালিকপক্ষের সহযোগিতায় নেশার ঘোরে রাখা হয় শ্রমিকদের। পরিকল্পিতভাবে প্রতিটি চা বাগানে রয়েছে মদের দোকান। তাদের ঘোরের মধ্যে রেখে চালাচ্ছে শ্রম শোষন। চা বাগানের এই জনগোষ্ঠী এখনও ব্রিটিশ সামন্তবাদ আর স্থানীয় বাবু-সাহেবদের বেড়াজাল ছিন্ন করতে পারেনি। একরকম দাসের মতো জীবন কাটালেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে উৎপাদন ধরে রেখেছেন চা শিল্পীরা৷

দৈনিক ১২০ টাকা মুজুরিতে চা বাগানে কাজ করছে চা শ্রমিকরা। উর্ধমুখি দ্রব্যমুল্যের এই বাজারে ১২০ টাকায় একজন চা শ্রমিকের সংসার চলেনা। এই টাকা দিয়ে সবজি, মাছ, তেল, লবণ, ডাল, সাবান, চিকিৎসা ব্যয়, পোশাক, প্রসাধনী, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ সবই করতে হয়। বিষয় যেকোনো মানুষের কাছে বিস্ময়কর মনে হলেও এটাই বাস্তবতা।

চা শ্রমিকদের শ্রম শোষন করে চা বিদেশে রপ্তানী ও দেশে বিক্রি করে টাকার পাহাড় গড়ছেন চা কোম্পানীগুলোর মালিকরা। এই স্বল্প পারিশ্রমিকে চা শ্রমিকের পরিবারের লোকজনদের কষ্টের জীবন কাটলেও তাদের শ্রম শোষনকারি চা কোম্পানী মালিকদের পরিবার বিলাসি জীবন যাপন করছেন। চা শ্রমিকরা দৈনিক ১২০ টাকা মুজুরির বদলে ৩০০ টাকা মুজুরি দাবি করেছে। তাও দ্রব্যমুল্যের উর্ধগতির এই বাজারে তা খুবই সামান্য। এই টাকাইও একটি পরিবারের ভরনপোষন কষ্টসাধ্য ব্যাপার। চা শ্রমিকের মুজুরি নুন্যতম দৈনিক ৫০০ টাকা করা উচিত। ১৭০ টাকা মুজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা শ্রমিকরা আন্দোলনে রাজপথে নেমেছে।

পাতা তোলার ভর মৌসুমে দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে সাময়িক কর্মবিরতির পর এবার অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটে গিয়েছেন লাখো চা শ্রমিক। এতে বাগান অচল হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

শনিবার সকাল থেকে সিলেট ভ্যালির ২৩টি, হবিগঞ্জের ২৪টি এবং মৌলভীবাজারের ৯২টি বাগানসহ মোট ২৪১টি চা বাগানের শ্রমিক একযোগে এ ধর্মঘট শুরু করেন। এ সময় শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রেখে বাগানের বিভিন্ন সেকশনে মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে শ্রমিকরা এই কর্মসূচি পালন করছেন। এর আগে ৯ অগাস্ট থেকে প্রতিদিন দুই ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করছিলেন তারা। কর্মবিরতি শেষে দিনের বাকি সময়ে তারা কাজে ফিরেছিলেন।

তবে দাবি না মানলে বাগান ‘অচল’ করে দেয়ার হুমকি তখনি দিয়েছিলেন শ্রমিক নেতারা। এর মধ্যে শ্রমিকদের সঙ্গে শ্রম অধিদপ্তরের সমঝোতার আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস পাননি শ্রমিকরা। এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার সকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে আন্দোলনরত চা শ্রমিকরা। এই আন্দোলন দমাতেও এই সরকারের পুলিশ বন্দুক তাক করেছে আন্দোলনরত চা শ্রমিকদের উপর। বিষয়টি খুবই লজ্জার। সরকার কি জনগনের না গুটি কয়েক ধনবান চা কোম্পানী মালিকদের। জনগণের টাকায় কেনা অস্ত্র সেই জনগণের ওপরই প্রয়োগ করা হয়! সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত চা শ্রমিকদের দাবি পুরন করে শান্তিপুর্ণ সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহন করা। জয় হোক মেহনতী চা শ্রমিকদের আন্দোলন।

বাংলাদেশ জার্নাল/জিকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত