ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

ভাঁড়: সেকাল-একাল

  মোস্তফা কামাল পাশা

প্রকাশ : ১১ মে ২০২১, ১৯:৫১

ভাঁড়: সেকাল-একাল
প্রতীকী ছবি

গোপাল ভাঁড় বাংলা রম্য সাহিত্য ও রস জগতের সম্রাট অবশ্যই। মধ্যযুগে আরো ছিলেন বীরবল এবং নাসিরুদ্দিন হোজ্জা। তাৎক্ষনিক মজা না শুধু, মহারাজ কৃঞ্চকান্তকে সমস্ত বিপদ-আপদে উপস্থিত বুদ্ধি ও কৌশলে সুরক্ষাও দিতেন গোপাল। রাজ দরবারে ভাঁড় হয়েও তিনি সব উজির নাজিরের তুলনায় বেশি মর্যাদা পেতেন। সততা, দূরদর্শিতা, উপস্থিত বুদ্ধির সাথে মজার পাঁচফোড়ন মিশিয়ে চতুর, মতলববাজ ও লোভী বড় উজিরসহ সব অমাত্যকে ঘোল খাইয়ে ছাড়তেন। রাজ্যের বড় বড় বিদেশি শত্রুদের কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও উপস্থিত বুদ্ধির প্যাঁচ কষে এমন সাইজ করতেন, বাপ বাপ বলে লেজ তুলে পালাত।

কিন্তু রাজার সবচে' প্রিয় এবং প্রচুর পুরস্কার পেয়েও টাকার অভাবে অনেক সময় চাল-ডালও কিনতে পারতেন না। খুন্তিহাতে বউয়ের তাড়া খেয়ে ভূঁড়ি বাগিয়ে দৌড়াতে হতো বেচারাকে। তুলনায় এ যুগের ভাঁড়েরা ঘি, মধু মাখনে দারুণ মউজে আছে। গোপাল নন্দনকাননেও ঘুরে বেড়াতেন। যমরাজকে আচ্ছামতন শিক্ষা দিতেন। এ যুগের ভাঁড়েরা ঠিক উল্টো। তারা কথার তুবড়ি ফুটিয়ে মোটুকে পাতলু করে দেয়, আবার পাতলুকে মোটু! এরা এ যুগের রাজনীতিক, বেনিয়া সামন্ত প্রভুদের চব্বিশ ঘণ্টা জুতো চাটতে দারুণ চৌকস। টানা চাটায় জুতোর সুখতলি পেটে গিয়ে নাদুসনুদুস ভূঁড়িও বাগায়। প্রভুভক্ত কুকুর হয়ে গোপালের মত ইন্দ্রসভার রম্ভা, উর্বশী নিয়ে টানাহেঁচড়া বা নন্দনকানন ছুঁতে না পারলেও পৃথিবীর এ-মাথা ও-মাথা নাকি চক্করও দেয় কেউ কেউ। আবার ঘন ঘন এসব কেচ্ছা শুনিয়ে বহুৎ ভক্ত, অনুরক্তকে ভাঁড় বিদ্যা শিক্ষা দেয় হাতে-কলমে। রাজনীতি-কর্পোরেটসহ সব পেশায় ভয়াল দুষণ ছড়াচ্ছে চিনেজোঁক ভাঁড়বাহিনী। এদের মেধা-মনন ছেঁকে আনতে জবরদস্ত ঘুঁটা দিলে নর্দমার পচা জঞ্জাল ছাড়া কিছুই মিলবে না!

অথচ গোপাল ছিলেন অসাধারণ এক দেশপ্রেমিক, রাজ্য ও রাজা কৃঞ্চকান্তের সব বিপদ তাড়ানিয়া বিশ্বস্ত বন্ধুও। তিনি হয়ে গেলেন কিনা ভাঁড়! এ যুগের ভাঁড়েরা আপনার-আমার চারপাশে কিলবিল করছে। ব্যাঙাচির মতো অসংখ্য ছানাপোনাও পয়দা করে যাচ্ছে। এরা ভাঁড় পয়দায় পুরোই গিনিপিগ প্রজাতির। প্রভুর জুতো চাটতে চাটতে জুতোজোড়াই হজম করে ফেলে একসময়। তারপর সুযোগমত প্রভুকে চেটে পাতলু বানিয়ে ভ্যানিশও করে দেয়। প্রভু বুঝতে পারলে জুতোসহ নিজে বাঁচে- নাহলে খেল খতম তার- পুরো তন্ত্রমন্ত্রসহ! কথা হচ্ছে, গোপাল ভাঁড়কে বাংলার শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক না বানিয়ে ভাঁড় বানানো হলো কোন যুক্তিতে! আহাম্মক কেতাব রচনাকারিকে আচ্ছামতন ধোলাই দেয়া উচিত নয় কী? জানিইতো, হ্যাঁ কইবেন না, ককখনো।

গোপাল কী আসলে ভাঁড় ছিলেন? না, পুরো কাহিনি জুড়েই তাঁর জ্বলজ্বলেে অবস্থান, সর্বকালের সেরা দেশপ্রেমিকের প্রতিকৃতি হয়ে। তিনি রাজা কৃঞ্চকান্তের মন যোগানো বা খুশিতে রাখার মত ভাঁড়ামো কখনো করেননি। বরং রাজা-রাণীসহ রাজ্যের বিপদ তাড়ানিয়া সবচেয়ে বড় ছায়াবৃক্ষ ছিলেন। রাজ্যে যত বড় বিপদ আসুক, বুক পেতে উপস্থিত বুদ্ধি ও কৌশলের প্যাঁচ কষে রক্ষা করেছেন রাজা ও রাজ্যকে। এমনকি মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর ও কুচক্রি বড় উজিরের সব চক্রান্ত বরবাদ করে দেন বারবার। হ্যাঁ, কুচক্রি অন্য সব উচ্চাকাঙ্খী লোভীদের নাক ফুটো করে দড়ি ঢুকিয়ে নাচাতে দারুণ সব মজার কাণ্ড ঘটিয়ে রাজা ও দরবারকে বিনোদিত করতে ছিলেন তুলনাহীন। লোভি উজির-নাজির, রাজপণ্ডিত, আমাত্য, বণিক, ভিনদেশি এমনকি আগন্তুক অসাধু ইংরেজদেরও ঘোল খাইয়ে রাজ্য থেকে তাড়িয়েছেন। দরবারের রাজ পণ্ডিত, গণক ঠাকুর, সেনাপতি বা ক্ষমতাধর কেউ 'বেগড়বাই' করলেই বুদ্ধির প্যাঁচ কষে এমন আছাড় দিতেননা, হাসির শেল ফাটত দরবারে। হাসির বোমাটি পুরো রাজ্যে হাসির জোয়ার তুলতেন দুর্জনকে শায়েস্তা করে। রাজার কঠিন অসুখ সারাতে জীবন বাজি রেখে রাজ কবিরাজের নিধান যোগাড়ে অসাধ্য অভিযানে নেমে সফল হয়েছেন।

প্রায় অশিক্ষিত, প্রামাণিকের মতো নিম্নবর্ণের গোপালকে হেয় করতে দরবারের উচ্চপদ ও বংশীয়রা দলবেঁধে হামলে পড়তো। কিন্তু গোপালতো বাইন মাছ! পিছলে বেরিয়ে এসে ওদের নাস্তানাবুদ করে ল্যাঙুট খুলে নিয়ে উল্টা কাদায় ডুবাতেন। নিজের নাপিত বা প্রামাণিক পরিচয়ে একটুও অস্বস্তি ছিল না তার, বরং গর্ব ছিল। গোপাল দেশপ্রেমের জারকে হাস্যরসকে সমার্থক করে ফেলেছেন- এটাই গোপাল চরিত্রের সবচে' বড় বৈশিষ্ট্য। তাকে প্রচলিত ভাঁড়ের সাথে কোনভাবেই মেলানো যায় না। বিপরীতে বর্তমানে দেশজুড়ে ভাঁড় সম্প্রদায়ের দেশপ্রেম নয়, আত্মপ্রেমই সবচে' বড় প্রেম! তারা আছে বড়ই আমোদে! গোড়া থেকে ডগা পর্যন্ত কিলবিল করছে ভাঁড়ের পাল। নিচেরটা উপরেটার জুতো চাটে- এক তাক উপরেরটা তার উপরেটার, এভাবে দেশে ভাঁড়ের সিড়ি আসমান ছুঁয়েছে!

ভাঁড় শুধু রাজনীতিতে না, সব ঘরানায় বিপুল প্রবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। জাতির আয়না মিডিয়া দেখি আগে। অনেক ভাঁড় মিডিয়ায় নিজস্ব পকেট পোষে। যারা পারে না, তারা বিশিষ্টের পা চাটে নানাভাবে। আবার নিজের নামে একখান লেখা ছাপাতে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলের জুতো চাটে কিছু ভাঁড়। নিজের পকেট ও বাছাই জনের (সুন্দরী কবি, লেখিকা সংখ্যায় বেশি) অপাঠ্য লেখা ছাপাতে দায়িত্বশীল জন মালিকের জুতো চাটে টানা। একটুও অরুচি নেই কারো। কারণ এতে বিষয়-বৈভব, রূপ-যৌবন, নাম-খ্যাতি পদক, ব্যবসা সব এক ঢিলে শিকার করা যায়। আবার কিছু বর্জ্য ভাঁড় কমিশন ও চাঁদা হাতিয়ে পেট ও তলপেট সেবা চালু রাখতে জুতো চুমোয় বিশিষ্টের। তিলকে গোলালু বানায়, আবার পুঁঠিকে বানায় মস্ত রুই-কাতল! ইতিহাস-ভূগোল বানায় নিজের মতো করে।

সমস্যা হচ্ছে, ওয়াজের জজবায় বেভুল মাওলানার মতো অনেক সময় টাইমিংয়ে ভুল করে ফেলে কেউ কেউ। ভুল সময়ে তবলায় তাল ঠুকতে গিয়ে নিজের তবলাই ফাটিয়ে ফেলে। সেলাই করে দেয় বউ-শালা-সম্মন্দিতে মিলে! তাও গজরাতে গজরাতে। যদিও শালা-সম্মন্দিদের উত্থান-জাগরণ পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেচারা ভগ্নিপতিই একসময় গুছিয়ে দিয়েছেন। এমনকি স্বঘোষিত আলিশান চাকরি সরকারি প্লটও! এখনতো এদের কেউ কেউ স্বনামধন্য মাশাল্লাহ, বাতিলকে গুনতিতে কেন নেবে!

অফিস-আদালত, আমলাতন্ত্র-গণতন্ত্র- কর্পোরেট বডি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, পেশাতন্ত্র, পেশীতন্ত্র সবখানেই ভাঁড়ের শিকলতন্ত্র! কোথা যাবেন? কল্লা ঢোকাতেই হবে ভাঁড়তন্ত্রের আংটায়! না ঢোকালে আপনি জনাব, একঘরে একদম! যত বড় দেশপ্রেমিক হোন, যতই সনিষ্ঠ সৎ ও কাজের প্রতি কঠিন দায়বদ্ধ, আপনি নীলবর্ণ শৃগাল হয়ে যাবেনই। গোপাল ভাঁড়ের সততা, দেশপ্রেমের সুবাসিত পেশাব গেলার যোগ্যতাও নেই এই ভাঁড়তন্ত্রের জনাব। অতএব জয়তু গোপাল প্রামাণিক; নিপাত যাক ভাঁড়তন্ত্র।

লেখক: মোস্তফা কামাল পাশা, সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গল্পকার

  • সর্বশেষ
  • পঠিত