ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

দ্য এসএমএস

  রূপান্তর: বিপুল হাসান

প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২১, ২২:০০

দ্য এসএমএস

হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ। হ্যাপি বার্থ ডে টু আউর ডটার। হ্যাপি বার্থ ডে টু এমিলি।

দশম জন্মদিনে মা আর বাবা গান গেয়ে ঘুম ভাঙালো এমিলি ব্রাডলির। এটা অবশ্য তার সৎ বাবা। চার বছর আগে এমিলির বাবা রোড এক্সিডেন্টে মারা যান। মা উনাকে দুই বছর আগে বিয়ে করেছেন। এই বাবাটা আগে এমিলিকে আদর করতো । এখন আর করেন না। মাও নতুন বাবার পাল্লায় পরে কেমন যেন হয়ে গেছেন। এমিলি কোনো কিছু আব্দার করলে মা বকা দেন। মায়ের সঙ্গে বাবাও এসে বকাঝকা করতে থাকেন।

এইতো সেদিন বাবা-মায়ের কাছে একটা মোবাইল ফোন চেয়েছিল সে। মা চোখ পাকিয়ে বললেন, তোমার এখনও মোবাইল ব্যবহারের বয়স হয়নি। অথচ এমিলির সব ফ্রেন্ডের হাতেই এখন মোবাইল আছে। এ কথা বলতেই মা খেপে গেলেন। ধমকে ওঠলেন, দেখছো আবার মুখে মুখে তর্ক করে।

‘এমনিতেই পড়ালেখায় লবডঙ্কা’, পেছন থেকে ফোড়ন কাটেন নতুন বাবা। ‘হাতে ফোন পেলে পড়াশোনা সব শিকেয় উঠবে।’

এমিলির কি যে খারাপ লেগেছিল। পড়ালেখার সাথে ফোনের কি সম্পর্ক! তাছাড়া, একদম খারাপ ছাত্রীও সে না। সেদিন রাতে খুব কেঁদেছে এমিলি। বার বার মনে হচ্ছিল, তার আসল বাবা যদি বেচে থাকতেন । অবশ্যই তার আব্দার পূরণ করতেন।

মা আর বাবা একসঙ্গে আবার গেয়ে ওঠলেন, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ। আরে নতুন বাবার হাতটা যে এতক্ষণ পেছনে দিকে একটা কিছু আড়াল করে রেখেছিল টেরই পায়নি

জন্মদিনের সারপ্রাইজ হিসেবে বাবা-মার কাছ থেকে মোবাইলটা উপহার পেয়ে কিযে ভালো লাগলো এমিলির। দৌড়ে গিয়ে তাদের জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ভালোবাসি। তোমাদের দুজনকেই খুব বেশি ভালোবাসি আমি।

দশম জন্মদিনটা দারুণ কাটালো এমিলি। বিশেষ করে মোবাইল উপহার পেয়ে সে দারুণ খুশি। রাতে ঘুমানোর সময় মাথার কাছে ফোনটা রখে দিলো।

বিছানায় ঘুমোতে যাবে এমন সময় হঠাৎ ইনবক্সে একটা ম্যাসেজ আসার সংকেত বাজলো, ফোনটাতে জ্বলে উঠলো আলো। প্রথমে ভাবলো অপারেটররা বোধহয় তাদের নতুন কোনো অফার জানিয়ে টেক্সট পাঠিয়েছে। শুনেছে, সময়ে অসময়ে অপারেটররা অফার জানিয়ে এসএমএস পাঠায়। তাছাড়া এখন পর্যন্ত এমিলি কাউকে এ নম্বরটা দেয়নি, বাবা-মা ছাড়া কেউ জানে না যে এমিলির একটা নতুন ফোন হয়েছে। অপারেটরদের অফার-ই হবে।

ফোনটা হাতে নিল। ইনবক্স খুল এসএমএসটা পড়লো।

‘ভালো হয়েছে। এখন আমি তোমার সাথে কথা বলতে পারবো।’

নাহ, এধরনের টেক্সট অপারেটাররা পাঠায় না । তাহলে কে পাঠালো? এমিলি বুঝতে পারলো না এসএমএসটা কে পাঠিয়েছে। সে এসএমএসের কোন উত্তর দিলো। কেউ ভুল করেও তো পাঠাতে পারে। তাছাড়া মা বাবা বলে দিয়েছে রাত নয়টার পর ফোন ব্যবহার না করতে। এখন রাত দশটা বাজে। কিন্তু সে ভিতরে ভিতরে প্রবল ভাবে জানতে চাইলো-কে এসএমএসটা পাঠালো।

এমিলি ফোনটা বন্ধ করে দেবে ভাবলো, ঠিক তখনই আরেকটা এসএমএস এলো- ‘দয়া করে সাড়া দাও। খুবই জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ।’

এবার এমিলি ফোনটা বন্ধ করে দিল। কিন্তু ঘুমাতে পারলো না। অস্বস্তি লাগছে তার। কে এসএমএস পাঠালো? কী এমন জরুরী আর গুরুত্বপূর্ণ। শেষপর্যন্ত কৌতুহলেরই জয় হলো। এমিলি বাবা মার কথার অবাধ্য হয়ে এসএমএসের সাড়া দিতে সিদ্ধান্ত নিলো।

ফোনটা অন করলো এমিলি। লিখলো-

‘আপনি কে?’

জবাব পেলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। ‘আমি তোমার ভাই’।

ভুরু কুচকে গেলো এমিলি। ভাবলো কেউ কি তার সঙ্গে ইয়ার্কি করছে নাকি! জবাব লিখলো- ‘সরি, আমার কোনো ভাই নেই’।

‘হ্যা, এখন নেই। কিন্তু ছিল।’

‘মানে কি? আপনি মিথ্যা বলছেন। আপনি কে? '

‘আমি তোমার ভাই। কিন্ত আমি মৃত '।

এমিলির হাত থেকে ফোনটা প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। সে এবার নিশ্চিত, কেউ তার সঙ্গে দুষ্টুমি করছে। কিন্তু কে পাঠাবে টেক্সট! যে নম্বরটি কেউ জানে না।

এবার আরেকটা এসএমএস এলো। ‘এমিলি, আমি দুঃখিত তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য।’

সবকিছু কেমন যেন অবিশ^াস্য লাগছে এমিলির। হঠাৎ মনে হলো, যে নম্বর থেকে এসএমএস আসছে সেখানে একটা কল দিলেই তো হয়। কে এসএমএস পাঠাচ্ছে জানা যাবে। ইনবক্সে গিয়ে দেখলো, ইনকামিং এসএমএসের জায়গায় কোনো ডিজিট নেই। ডিজিটের জায়গায় ওঠেছে কয়েকটা স্টার (*) চিহ্ন দেখতে পেল সে।

আবার এসএমএস এলো। ‘আমার নাম ব্রোহান, আমি তোমার ভাই’।

এমিলির রাগ লাগছে। ব্রোহান নামে কাউকে সে চিনে না। অথচ রাত দুপুরে নম্বর লুকিয়ে রেখে সমানে এসএমএস পাঠাচ্ছে। ফাজলামির আর জায়গা পায় না। অনেক হয়েছে, যত্তোসব। সে লিখলো- ‘রাত দুপুরে ফাজলামি করার জায়গা পান না, অন্যখানে গিয়ে নেন।'

‘মজা আমি করছি। মজা করার মতো অবস্থা আমার নেই। যাকে হত্যা করা হয়েছে, সে মজা করতে পারে না।’

এবার সত্যিই ভয় পেয়ে গেল এমিলি। ভয়ে বুক কাঁপছে তার। কোন উন্মাদের পাল্লায় পড়েছে সে কে জানে।

এর মধ্যেই আরেকটা এসএমএস এলো। ‘প্লিজ, আমাকে বিশ্বাস করো। তুমি বিপদের মধ্যে আছো। তোমার সতর্ক হওয় উচিত’।

আতঙ্ক এমিলির গলা শুকিয়ে এলে। কি হচ্ছে এসব! এ কোন রহস্যময় জগতের মধ্যে ঢুকে পড়লো সে। মনটা শক্ত করে সে নতুন টেক্সট লিখলো।

‘আপনি যদি মৃত-ই হন এসএমএস লিখছেন কী করে? মৃত মানুষ এসএমএস পাঠাতে পারে না।’

‘দুঃখিত, আমার দেহটা মৃত কিন্তু আমার আত্মা জেগে আছে।’

‘এটা হতে পারে না, এটা অসম্ভব।’

‘তুমি জানা খুন হওয়া মানুষের আত্মার অনেক ক্ষমতা। অতৃপ্ত আত্মা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়। অনেক কিছু সে দেখে, বুঝতে পারে। কিন্ত শরীর না থাকায় কিছু করতে পারে তবে এসএমএস তৈরি করতে পারে। আমাকে বিশ্বাস করো।

আরো একটি এসএমএস এলো-

‘স্কুল ছুটির পর তুমি বেক্সলি কবরস্থানে এসো। তোমার ফোনটিও নিয়ে এসো।’

‘কবরস্থানে কেনো?’ এমিলি লিখলো।

‘প্রমাণ দিতে চাই যে, আমি তোমার ভাই।’

‘তুমি কি আমাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছো? কেনো এরকম এসএসএস পাঠাচ্ছো’। ‘যদি তুমি ভয় পেয়ে থাকো, সত্যিই দুঃখিত। আসলে আমি তোমাকে সহযোগিতা করতে চাই। বাঁচাতে চাই’।

এমিলি আর কোনো জবাব না দিয়ে ফোন বন্ধ করে দিলো। তার গা ছম ছম করছে। ভয় কাটাতে তার যতো সুরা মুখস্ত আছে জপতে লাগলে। সারারাত ঘুম এলো না।

এমিলি স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে সবসময় হৈ চৈ করে সময় কাটায়। পরের দিন সে মনমরা হয়ে ক্লাস করলো। টিফিন প্রিয়ডে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পর্যন্ত গেল না। এমনকি সে যে জন্মদিনে চমৎকার একটা মোবাইল ফোন উপহার পেয়েছে, কাউকে সে কথা বললো না। কাউকে ফোনটি দেখালো না। নম্বরটিও কাউকে দিলো না।

স্কুল শেষে অন্যদিনের মতো বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ি না ফিরে কবরস্থানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। তার ভেতর অদ্ভূত কৌতুহল, এই কৌতুহলের কথা কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারলো না। কাউকে সঙ্গে নেওয়াও হলো না। একা একাই বেক্সলি কবরস্থানে ঢুকলো। ব্যাগের রাখা মোবাইল থেকে ভেসে এল এসএমএস আসার সংকেত। ব্যাগ থেকে মোবাইলটি বের করে সে টেক্সট পড়লো।

‘কবরস্থানের মাঝামাঝি বড় শিরিষ গাছটার নিচে আসো’।

সম্মোহিতের মতো সে সামনে এগিয়ে গেলো। ওই তো সামনে দেখা যাচ্ছে শিরিষ গাছটা। সে গাছটার নিচে এসে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গেই এসএমএস এলো- ‘ডানপাশের দ্বিতীয় কবরটা সামনে আসো। পাথরে খোদাই এপিটাফে কি লেখা আছে পড়ো।’

এমিলি অবাক বিস্ময়ে দেখলো এপিটাফের পাথরে খোদাই করা নাম -

ব্রোগান জে. ব্রাডলি - জন্ম: ০৬ জুলাই, ১৯৯০/ মৃত্যু: ২ নভেম্বর ২০১২। এমিলির সৎবাবার নামের পদবী ‘ব্রাডলি’। তার মানে ব্র্ােগান হলো তার সৎ ভাই।

এসএমএস এলো, ‘দেখো, আমি তোমার ভাই। সে আমাকে হত্যা করেছিল। রটিয়ে দিয়েছিল গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট।’

‘কে তোমাকে হত্যা করেছে?’ - এমিলি টাইপ করলো।

‘উনি ছিলেন আমার বাবা, আর এখন তিনি তোমার সৎ বাবা। কিন্ত তোমকে সে দেখে ফেলেছে।’

‘আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না। উনি কেন এটা করবো।’

‘মা মারা যাওয়ার পর আমাকে তিনি বোঝা মনে করতেন। তাছাড়া ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েছিলেন। দুইভাবে লাভবান হন। ঘাড়ের বোঝা আমাকে সরালেন আবার ইনসিউরেন্স থেকে টাকা আদায় করে দেনমুক্ত হলেন।’

‘আমার বিশ^াস হয় না। মি. ব্রাডলি খুব ভালো লোক। সৎবাবা হলেও আমাকে খুব আদর করেন।’

এসএমএসে জবাব এলো, ‘তিনি এতোই ভালো লোক যে এখন তোমাকে দুনিয়া থেকে সরানোর জন্য আসছেন। এখনই এখানে এসে পড়বেন তিনি। পালাও এমিলি পালাও।

ভুড়– কুঁচকে টেক্সট পড়লো। ঘাড় ঘুড়িয়ে চারপাশে দেখলো। শুনশান নিরব। কবরস্থানের এপাশটায় কেউ নেই। হালকা হাওয়া কিছু ঝরে যাওয়া পাতা উড়িয়ে নিয়ে গেল। এমিলি লিখলো-

‘তুমি কি বলছো? আমি বুঝতে পারছি না। কেনো পালাবো? কোথায় পালাবো?

‘দেরি করে ফেলেছো এমিলি, পালানোর আর সময় নেই।’

পিছন থেকে খুট করে একটা শব্দ শুনতে পেলো। বিশাল শিরিষ গাছের আড়াল থেকে একজন লোক। ধীর পায়ে লোকটা এগিয়ে আসতে আসতে বললো।

‘এমিলি ফোনটা তোমাকে উপহার দেওয়া হয়েছে কবরস্থানে নিয়ে আসার জন্য নয়।’ এমিলি পিছন ফিরে দেখলো তার সৎ বাবাকে। পকেট সাদা রঙের নাইলনের রশি বের করতে করতে তিনি বললেন, ‘একা একা কবরস্থানে আসা মোটে উচিত হয়নি তোমার।’

[চার্লস লি রচিত ‘দ্য এসএমএস অন এমিলিস নিউ ফোন’ এর ভাবানুবাদ]

বাংলাদেশ জার্নাল- বিএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত