অরণ্য আপনের তিনটি কবিতা
শিল্প-সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশ : ২৫ মে ২০২২, ২২:৪৪
।। মা, তুমি তো জানতে! ।।
মা, তুমি তো জানতে!
এই পথ অন্ধকার হবে
এই আলো অন্ধকারের জিহবা টেনে নিয়ে যাবে
ধান আজরা আইলের পথ বন্ধ হয়ে যাবে
এই মূর্খের রাত আমাকে কুরে কুরে খাবে
ঘুমের স্তন চুষে চুষে আমি কেন মারা যাই না
অন্ধকারের যোনির ভিতর আমি কেন ডুবে যাই না
এত থকথকে অন্ধকার
এত নরম হাড্ডিহাড়
মৃত্যুর মতো... অদৃশ্য প্রভুদের মতো আমি কেন মিশে যাই না
এই পৃথিবীর পরিচিত রোদের অন্তরে গিয়ে ভিজে গেছি
বৃষ্টি নেমেছে... মাঠের রাখাল গোরু নিয়ে ছুটেছে
ঝাঁকড়া মাথার কাঁঠাল গাছের নিচে আমি দাঁড়িয়ে থেকেছি
তুমি আসোনি মা
মাটির কত নিচে তুমি চলে গেছ? আকাশের কোন গ্রামে তুমি বসতি গেড়েছ?
আমাকে বলো মা!
বেদম ব্যথায় আমার বুক ছিদ্র হয়ে যায়
আমার চোখ থেকে আকাশ পড়ে যায়
মনে হয় গাছের ডালের পাখিদের ভিতর তুমি দলবেঁধে আছ
মনে হয় ফোটুর দিঘির মাছেদের মধ্যে তুমি ঝাঁক বেঁধে আছ
মনে হয় মাগরিবের আজান হলেই তুমি বাড়ি ফিরবে
মনে হয় আমাকে খিদে পেলেই তুমি বাড়ি ছুটে আসবে
হৃদয়ের সমস্ত ব্যথা কাঁটার মতো
হৃদয়ের সমস্ত স্মৃতি শোকের মতো
আমি আর নিতে পারছি না
এত শুয়োরের এত গিদরের এত খবিশের বারামখানা এই পথে!
মা, তুমি তো জানতে!
এই পথ অন্ধকার হবে
এই আলো অন্ধকারের জিহবা টেনে নিয়ে যাবে
আকাশেও চিৎকার করিনি
জমিনেও চিৎকার করিনি
কোথাও আমি দাবি করিনি আমি মানুষ
বুকেও লিখে রাখিনি আমি মানুষ
পিঠেও লিখে রাখিনি আমি মানুষ
আমি জানি না মানুষ দেখতে কেমন
আমি শুধু জানি কুকুরের মতো আমি দেখতে না
আমি শুধু জানি শুয়োরের মতো আমি দেখতে না
আমি কখনও মানুষ দেখিনি
আমি হয়তো কুকুরের ভিন্ন জাত
আমি হয়তো শুয়োরের ভিন্ন জাত
জীবন আমার সামনে চোরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে
ইচ্ছে করে তাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলি
পৃথিবী আমার সামনে নগ্ন হয়ে থাকে
দুচোখে তাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে না
তোমাকে ছাড়া আমার ভালো লাগে না মা!
কেন আমি অশ্বত্থের শাখার ভিতর ঢুকে গায়েব হয়ে যেতে পারি না?
কেন আমি পাকুড় গাছের ঝুরি ধরে আকাশের বাইরে ঝাঁপ দিতে পারি না?
কাগজি লেবু গাছের পাশে ধানক্ষেতের ধারে শুয়েছিলাম...
আর জাগব না
কখন ফুরালাম আমি বড়লোকের সম্মানের মতো? আহা জীবন চলে গেছে আষাঢ়ের রাতে
টল্লা বাঁশের বন অন্ধকারের শান্ত ঘুম পেয়ে আনন্দে মাতে
ঘুমের ভিতর মৃত কুকুরের মুখ, গু মাখা শুয়োরের মুখ ছায়ার মতো ভাসে
ঘুম ছাড়ে-- দেখি মাটির বুকে শুয়ে আছি ঘাস হয়ে ঘাসে
ঘুমের স্তন চুষে চুষে আমি কেন মারা যাই না
অন্ধকারের যোনির ভিতর আমি কেন ডুবে যাই না
আমি আজমিরি বাসের হেল্পার
মা, তুমি তো জানতে!
।। স্বাধীনতার ঈশ্বর ।।
এই রাতে আমাকে কোথায় ধরে নিয়ে যাও
আমি যেখানেই যাব
আলো হয়ে যাব
আমাকে বন্দি করার ব্যর্থ চেষ্টা কর না
আমি তো সাত কোটি মানুষের মনে বন্দি আছি
তেইশ বছর ধরে হেঁটে গেছি এই বাংলার পথে...
যখনই মানুষ অধিকারের কথা বলেছে
আমাকে পেয়েছে
যখনই মানুষ মুক্তির কথা বলেছে
আমাকে পেয়েছে
মাইকে আমাকে বাজাতে হবে না
বিজ্ঞাপনে আমাকে দেখাতে হবে না
বাংলার প্রতিটি মানুষ আমার বিজ্ঞাপন
তাদের প্রতিটি হৃদয় আমার সিংহাসন
অন্ধকারের শিশু দেখ কাঁদে
গাছের পাখি পড়েছে ফাঁদে
আমাকে ধরতে এসেছ ধর কিন্তু নিয়ে যাবে কোথায়
আমি যেখানেই যাই, আমার মন মানুষের কান্না শুনতে পায়
আমাকে আইন কর না
আমাকে ভালোবাসা কর
আমাকে ধরতে এসেছ
আমাকে ধর
আমার সাত কোটি মানুষের হাত
কোন হাতে পরাবে শিকল
আমাকে ভয় দেখানো এত সহজ না
আমার বুকে সাত কোটি মানুষের বল
আমাকে মারতে চাও মারো
আমার ক'টি মাথা ফেলবে
আমার কাঁধে তো সাত কোটি মানুষের মাথা
এই রাতে আমাকে কোথায় ধরে নিয়ে যাও
আমাকে বল তো!
এই বাংলার আমি কোথায় নেই?
।। ঠান্ডা রোদ।।
সারাজীবন নিজের ছায়ায় হেঁটে চলা মানুষ আমি
রাস্তায় যৎসামান্য যে রোদ কুড়ে পেয়েছি
তা সূর্য থেকে খসে পড়া ময়লা
এই রোদের ছায়া আমার
গাছের ছায়া আমি পাইনি
সংসারেও থাকতে পারিনি, বনেও যেতে পারিনি
জুতোর মধ্যে শুধু আমার পা থাকে না, আমার মাথাও থাকে
পায়েমাথায় জুতা পরা মানুষ আমি
আমি কিছু দেখতে চাইনে, শুনতে চাইনে
শুধু চলতে চাই
চলতে চলতে একদিন নিজের ছায়ায় পড়ে মরে যাব
আমি মরে গেলে আমার প্রেমিকা দেখতে আসবে
তাকে আমার গায়ে থাকা ঠান্ডা রোদ দিয়ে দিও
বেঁচে থাকতে তো তাকে কিছু দিতে পারিনি।
বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে