ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১০ মিনিট আগে
শিরোনাম

প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাচেষ্টাকারী মুফতি হাই আফগানিস্তানে তাদের পক্ষে যুদ্ধ করে

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২৬ মে ২০২২, ১৪:১০

প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাচেষ্টাকারী মুফতি হাই আফগানিস্তানে তাদের পক্ষে যুদ্ধ করে
ছবি: প্রতিনিধি

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বোমা পুতে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাচেষ্টা ও রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত এবং একাধিক মামলায় যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত আসামী জঙ্গি সংগঠন হুজি-বি’র প্রতিষ্ঠাতা আমীর মুফতি আব্দুল হাইকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব।

র‍্যাব বলছে, মুফতি হাই ১৯৮৯ সালে একাধিক বাংলাদেশিসহ বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি মিরানশাহ বর্ডার দিয়ে আফগানিস্থানে মুজাহিদ হিসাবে যায়। সেখানে বাংলাদেশের কয়েকজন জঙ্গি সদস্য ও ৩০/৩৫ জন পাকিস্তানি নাগরিক একত্রিত হয়ে একটি ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি এক হুজি নেতা এবং বাংলাদেশি এক জঙ্গির নেতৃত্বে একে-৪৭ রাইফেল ও থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। পরবর্তীতে আফগানিস্তানে গিয়ে তাদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করে।

বুধবার রাতে র‍্যাব-২ এর একটি আভিযানিক দল নারায়ণগঞ্জ এর ফতুল্লা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে জঙ্গি সংগঠন হুজি-বি’র প্রতিষ্ঠাতা আমীর মুফতি আব্দুল হাইকে (৫৭) গ্রেপ্তার করে। এর আগে ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার অন্যতম পলাতক আসামী জঙ্গি ইকবাল ও রমনার বটমূলে বোমা হামলা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক জঙ্গি মুফতি শফিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তার বিরুদ্ধে ৭টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে, যার মধ্যে ২টি মৃত্যুদন্ড ও ২টি যাবজ্জীবন কারাদন্ড। এছাড়াও তার নামে মোট ১৩টি মামলা রয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন রাজধানীর কাওরান বাজারে মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান।

সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব জানায়, ২০০০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায় জনসভার কিছুটা দূরে জঙ্গি মুফতি আব্দুল হাইসহ তার অন্যান্য জঙ্গি সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার চেষ্টার ঘটনার মামলায় ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট গ্রেপ্তার মুফতি আব্দুল হাইসহ ১০ জন মৃত্যুদন্ড এবং ৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড প্রদান করা হয়।

খন্দকার মঈন বলেন, ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে ছায়ানটের বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলাকালীন সময় প্রকাশ্য দিবালোকে জঙ্গিদের অতর্কিত বোমা হামলায় ঘটনায় ২০১৪ সালের ২৩ জুন আদালত ৮ জনকে মৃত্যুদন্ড এবং ৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। অপরদিকে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল-১ এ বিচারাধীন রয়েছে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে একটি জনসভা চলাকালে প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত এবং প্রায় তিন শতাধিক গুরুতর আহত হয়।

সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব আরও জানায়, ওই ঘটনায় ২টি পৃথক মামলায় দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল ১৯ জনকে মৃত্যুদন্ড এবং মুফতি আব্দুল হাইসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করেন।

গ্রেপ্তার মুফতি আব্দুল হাই ওই গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনার সাথে সম্পৃক্ত ছিল। অপরদিকে একই ঘটনায় ঢাকার মতিঝিল থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে একটি পৃথক মামলা হয়। গ্রেপ্তার মুফতি আব্দুল হাই বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামী।

এছাড়াও ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদরে বৈদ্যের বাজারে জঙ্গিরা গ্রেনেড হামলা চালিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ ৫ জনকে হত্যা করে এবং কমপক্ষে শতাধিক লোককে আহত করে। উক্ত হত্যা ও বিষ্ফোরক মামলায় গ্রেপ্তার আব্দুল হাই চার্জশীটভুক্ত পলাতক আসামী এবং তার বিরুদ্ধে ২ টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। তার বিরুদ্ধে কুমিল্লা জেলায় সর্বমোট ৭টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।

গ্রেপ্তারকে জিজ্ঞাসাবাদে খন্দকার মঈন বলেন, সে নারায়গঞ্জ জেলার দেওভোগ মাদ্রাসায় ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত হেফজ বিভাগে পড়ালেখা করে। এরপর ১৯৮১ সালে অবৈধভাবে পার্শ্ববর্তী দেশে যেয়ে দেওবন্দ দারুল উলুম মাদ্রাসায় লেখাপড়ার জন্য ভর্তি হয়। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত দেওবন্দে পড়ালেখা করে মাস্টার্স সমতুল্য দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করে। এরপর দেওবন্দ থেকে ১৯৮৫ সালের শেষে ঐ দেশের নাগরিক হিসাবে একটি পাসপোর্ট তৈরি করে পার্শ্ববর্তী দেশের নাগরিক হিসাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং ১৯৮৬ সালে পুনরায় ঐদেশে প্রত্যাবর্তন করে। পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে পাকিস্তানি ভিসা নিয়ে ট্রেনযোগে পাকিস্তানের করাচিতে যেয়ে সেখানকার একটি মাদ্রাসা থেকে ২ বছরের ইফতা কোর্স সম্পন্ন করে মুফতি টাইটেল অর্জন করে।

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ১৯৮৯ সালে ঐ মাদ্রাসায় একাধিক বাংলাদেশিসহ বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি মিরানশাহ বর্ডার দিয়ে আফগানিস্থানে মুজাহিদ হিসাবে যায়। সেখানে বাংলাদেশের কয়েকজন জঙ্গি সদস্য ও ৩০/৩৫ জন পাকিস্তানি নাগরিক একত্রিত হয়ে একটি ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি এক হুজি নেতা এবং বাংলাদেশী এক জঙ্গির নেতৃত্বে একে ৪৭ রাইফেল ও থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। পরবর্তীতে আফগানিস্তানে গিয়ে তাদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করে। এরপর ১৯৯১ সালে সে বাংলাদেশে ফিরে আসে।

তিনি আরও বলেন, আফগানিস্তানে থাকাকালীন “হুজি-বি” অর্থাৎ “হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি বাংলাদেশ” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। যার আমীর নির্বাচিত হয় গ্রেপ্তার মুফতি আব্দুল হাই। পরবর্তীতে মুফতি আব্দুল হাই আমীর হিসাবেই বাংলাদেশে আসে এবং ১৯৯১ সালে জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে হরকাতুল জিহাদ নামে প্রচারণা শুরু করে।

র‍্যাব মুখপাত্র বলেন, ১৯৯২ সালের প্রথম দিকে আব্দুল হাই কক্সবাজারের উখিয়ার একটি মাদ্রাসায় যায় এবং সেখানে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করে। পার্শ্ববর্তী দেশের এক জঙ্গি নেতা ঐ ট্রেনিং ক্যাম্পে অস্ত্র সরবরাহ করত এবং মুফতি আব্দুল হাই ও তার দুই সহযোগী সেখানে প্রশিক্ষণ প্রদান করত। উক্ত স্থানে তারা ৪ বছর অবস্থান করে এবং কৌশলে তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। এরপর ১৯৯৬ সালে যৌথবাহিনীর অভিযানে উক্ত ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে ৪১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

র‍্যাব জানায়, মুফতি আব্দুল হাই “জাগো মুজাহিদ” মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। পত্রিকাটি ১৯৯১ সালে চালু হয় এবং তার অফিস খিলগাঁও থানার তালতলা নামক স্থানে। পরবর্তীতে ২০০০ সালে সরকার পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করে। মুফতি আব্দুল হাই ২০০০ সালে ওই পত্রিকার অফিস থেকেই গ্রেপ্তার হয় এবং ২মাস কারাভোগ শেষে জামিনে মুক্তি পায়।

খন্দকার মঈন বলেন, গ্রেপ্তার মুফতি আব্দুল হাই ২০০০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কোটালীপাড়ার সভাস্থলে বোমা পুতে রেখে তাকে হত্যা চেষ্টা, ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়ে ১০ জনকে হত্যা, ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা চেষ্টাসহ ২৪ জনকে হত্যা এবং তিনশতাধিক লোককে আহত করা, ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদরে বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ ৫ জন নিহত এবং কমপক্ষে শতাধিক লোক আহতের ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিল।

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, আলোচিত বিভিন্ন জঙ্গিবাদী ঘটনার সাথে হরকাতুল জিহাদের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসলে ২০০৬ সালের পর মুফতি আব্দুল হাই আত্মগোপনে চলে যায়। তার পরিবার তখনও নারায়নগঞ্জেই বসবাস করত কিন্তু সে কুমিল্লা জেলার গৌরিপুরে তার শ্বশুরবাড়ী এলাকায় আত্মগোপন করে। গৌরিপুর বাজারে তার শ্বশুরের কেরোসিন ও সয়াবিন তেলের ডিলারশিপের ব্যবসা ছিল। সে সারা দিন ব্যবসা দেখাশুনা করে ঐ দোকানেই রাত কাটাত।

র‍্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, ২০০৯ সাল পর্যন্ত সে তার শ্বশুর বাড়ীর এলাকা গৌরিপুরে আত্মগোপনে ছিল। গৌরিপুরে আত্মগোপনে থাকাবস্থায় সে মাঝেমধ্যে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করে নারায়ণগঞ্জ যাতায়াত করত।

পরবর্তীতে কৌশলে সে তার ও তার পরিবারের সবার ঠিকানা পরিবর্তন করে নারায়ণগঞ্জে ভোটার হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। স্থানীয় এলাকাবাসী যেন তার পরিচয় জানতে না পারে সে জন্য ঘর থেকে খুব কম বের হত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে তার বর্তমান ঠিকানার বাসাটি এলাকার লোকজনের কাছে তার বড় ছেলের বাসা হিসেবেই পরিচিতি করায় বলেও জানান র‍্যাব কর্মকর্তা খন্দকার মঈন।

বাংলাদেশ জার্নাল/এফজেড/এসএস

  • সর্বশেষ
  • পঠিত