ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩৮ মিনিট আগে
শিরোনাম

প্রতারণার টাকায় একাধিক পাঁচ তলা বাড়ি, ফিসারিজ

  সুজন কৈরী

প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২২, ১৯:৩৭  
আপডেট :
 ১৯ আগস্ট ২০২২, ২০:১৮

প্রতারণার টাকায় একাধিক পাঁচ তলা বাড়ি, ফিসারিজ

মাদকসহ গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে গ্রেপ্তার। ছেড়ে দিতে তাৎক্ষণিক সমঝোতার মাধ্যমে মোবাইল ব্যাকিং মাধ্যম বিকাশ বা রকেটে নেয়া হতো টাকা। টার্গেট ব্যক্তি ছেলে হলে মাদকের কথা আর মেয়ে হলে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে আটক করার কথা বলে অভিভাবকের কাছে টাকা দাবি করা হতো টাকা।

অভিভাবকরা টাকা পাঠানোর পর প্রতারকরা বলতেন, ঘটনাটি সাংবাদিক ভিডিও করেছে। তখবাদিন সাংকদের ম্যানেজ করার কথা বলে আরও টাকা হাতিয়ে নিতো চক্রটি। এমনই একটি ভয়ঙ্কর প্রতারক চক্রের সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। পরে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা চক্রের দুই সদস্যকে।

গ্রেপ্তার দুইজন হলেন, আলামিন ওরফে আমিন ওরফে বিন ইয়ামিন (২৭) ও তার সহযোগী শরিফুল ইসলাম (২১)। তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, এক রাউন্ড গুলি, সিসি ক্যামেরার মনিটর, ডিভিআর, নগদ ২০ হাজার টাকা ও ১০০ বোতল ফেনসিডিল জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা ডিবি পুলিশ পরিচয়ে প্রতারণা করতেন।

পুলিশ জানায়, শনিবার ছাড়া সপ্তাহের ছয়দিনই চক্রটি ‘অভিযান’চালাতো। প্রতিদিন তাদের আয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। আলামিনের বিকাশ এবং নগদ নম্বরে সাম্প্রতিক সময়ে এক কোটি ১৬ লাখ টাকা লেন-দেনের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা।

তারা জানিয়েছে, প্রতারণার টাকায় আলামিন গ্রামে দুইটি পাঁচতলা ফাউন্ডেশনের বাড়ি বানিয়েছেন। ১০ বিঘা জমিতে করেছেন ফিসারীজ। দুইজনের নামে ঢাকা এবং ময়মনসিংহের বিভিন্ন থানায় থানায় রয়েছে এক ডজন মামলা।

দীর্ঘদিন ধরে প্রতারক চক্রের এই দুই সদস্যকে খুঁজছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু ধূর্ত আলামিন-শরীফুল অভিনব কায়দায় নজর রাখতেন আইশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর। ময়মনসিংহের ত্রিশালে তার নির্মাণাধীন পাঁচ তলা বিল্ডিংয়ের আশপাশের খেজুর, নারিকেল ও কাঁঠাল গাছে লাগিয়ে রেখেছিলেন ১৭টি সিসিটিভি ক্যামেরা। বাসা থেকে সেগুলো মনিটরিং করা হতো।

রাস্তায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাউকে দেখলেই বিকল্প থেকে চম্পট দিতো বাড়ি থেকে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গত এপ্রিল থেকে চারবার অভিযান চালিয়েছেন ত্রিশালের গ্রমের বাড়িতে। কিন্তু বারবারই পালিয়ে যান তারা। অবশেষে গোয়েন্দাদের অভিনব কৌশলে তারা ধরা পাড়েছেন। গত ১৬ আগস্ট তাদের গ্রেপ্তারের পর ১৭ আগস্ট আদালতে হাজির করে দুইজনকে চারদিনের রিমান্ডে নেয় ডিবি।

শুক্রবার রিমান্ডের দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত হয়েছে। রিমান্ডে তারা একে একে প্রতারণার নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছে।

প্রতারক চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে ডিবি গুলশান বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, আলামিনের বাড়ির রাস্তায় লাগানো সিসি ক্যামেরাগুলো ইন্টাররনেট প্রটোকলের (আইপি) মাধ্যমে চলতো। বার বার তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আমরা স্থানীয় ইন্টারনেট ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তার বাড়ির ইন্টারনেট কানেকশন বন্ধ করে দেই। সাদা পোশাকে ইন্টারনেট ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানের আশপাশে অবস্থান নেই। ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার কারণে শুরুতে ফোনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাকে ফোনে গালিগালাজ করে। ২-৩ ঘণ্টা পুর সরাসরি এসে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। এই সুযোগে আমরা তাকে গ্রেপ্তার করি। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী শরীফুলকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশ জানায়, বেশ কিছু দিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভুয়া ডিবির পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষকে আতঙ্কিত করে প্রতারণা চালাচ্ছিলো আলামিনের নেতৃত্বাধীন চক্রটি। ভুয়া ডিবির তৎপরতায় বিষয়ে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় বেশ কয়েকটি সাধারণ ডায়েরী (জিডি) ও মামলা হয়। এর প্রেক্ষিতেই তদন্তে নামে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্তে জানা যায়, ছয়টি বিয়ে করেছে আলামিন। এছাড়া তিনমাস এবং ছয়মাস মেয়াদী বিয়ে করেছেন অসংখ্য।

প্রতারণার কৌশলের বিষয়ে ডিবি পুলিশ জানায়, আলামিন ভিআইপি মোবাইল নাম্বার টার্গেট করে। টার্গেট নাম্বারগুলো হোয়াটসঅ্যাপে কিংবা ফেইসবুক এ সার্চ দিয়ে ফ্যামিলি হিস্ট্রি জেনে নেন। পরে নিজেকে ডিবি পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার পরিচয় দিয়ে ভিকটিমকে (অভিভাবক) ফোন করে। জানায়, তার ছেলে কিংবা মেয়ে পুলিশের হাতে আটক আছে। অভিভাবকের সন্তান ছেলে হলে বলে সে ইয়াবা নিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ছে। তাকে ছাড়াতে হলে এখনই বিকাশ কিংবা নগদে এক লাখ টাকা পাঠাতে হবে। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ম্যাজিষ্ট্রেট এই জরিমানা ধার্য করেছে। অন্যথায় তাকে কোর্টে চালান দেওয়া হবে। অভিাবকের সন্তান মেয়ে হলে তাকে বলে তার মেয়ে অসামাজিক কাজ করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। দ্রুত বিকাশ কিংবা নগদে টাকা না পাঠালে তার মেয়ে দলবদ্ধ ধর্ষন করা হবে। এ সময় অভিভাবক আতঙ্কিত হয়ে হয়ে দ্রুত বিকাশ কিংবা নগদে টাকা পাঠিয়ে দেয়। অভিভাবক তখন তার মেয়ের সাথে কথা বলতে চাইলে, তখন আসামিরা মেয়েলী কণ্ঠে আম্মু আম্মু/আব্বু আব্বু বলে চিৎকারের শব্দ শোনাতে থাকে। অভিভাবক টাকা পাঠানোর পর প্রতারক চক্রের সদস্যরা টার্গেট করা ব্যক্তিকে বলেন, সাংবাদিকরা ঘটনাটি ভিডিও করে ফেলেছে। এখন সাংবাদিকদের ম্যানেজ করার জন্য আরো টাকা লাগবে। এছাড়া অস্ত্র দেখিয়ে ডিবি পরিচয় দিয়ে মানুষকে জিম্মি করে অর্থ আদায় করতো চক্রটি।

ডিবি কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, প্রতরক চক্রের সদস্যরা অভিভাবকদের কাছে এমন সময় ফোন করে যখন তার সন্তান স্কুল-কলেজে থাকেন বা অন্য কোনো জরুরী কাজে থাকেন। ওই সময় সন্তানের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকে বা মোবাইল ফোন সঙ্গে থাকে না। তারা এমনভাবে ফোন করেন, যাতে টার্গেট করা ব্যক্তি তাৎক্ষনিকভাবে কী করবেন বুঝতে পারেন না। সন্তানের ভালো বিবেচনায় দ্রুত টাকা দিয়ে দেন। পরে সন্তানের সঙ্গে যখন অভিভাবকের কথা বা সন্তান বাসায় ফেরেন তখন অভিবাবক বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন।

তিনি বলেন, সম্প্রতি পর্যন্ত আমরা এ ধরণের আটটি ঘটনা পেয়েছি। কোনো ক্ষেত্রেই অভিভাবকরা যাচাই করে দেখেননি, তার সন্তান আসলে আটক হয়েছেন কিনা। তাই আমাদের পরামর্শ, এ ধরনের ফোন পেলে কেউ টাকা দিয়ে দেবেন না। সন্তানের সঙ্গে কথা বলা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন, অথবা বিষয়টি স্থানীয় থানা পুলিশকে জানাবেন।

বাংলাদেশ জার্নাল/এমএম

  • সর্বশেষ
  • পঠিত