কৃষি জমি কমছে ইটভাটা ও আবাসন ব্যবসায়ীর আগ্রাসনে
শওকত জামান
প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২২, ০৪:৩৭
ইটভাটা ও আবাসন ব্যবসায়ীদের আগ্রাসনে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। তিন ফসলি কৃষি জমি ধ্বংস এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে একের পর এক গড়ে তোলা হচ্ছে ইটভাটা, হাউজিংপ্রকল্প ,সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, বসতিসহ অকৃষি নানা কাজে। দিনকে দিন কমে যাচ্ছে আবাদি জমির পরিমাণ।
কৃষকের আয়ের উৎস কৃষি জমি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। অর্থ উপার্জনে কৃষি জমির প্রতি বেশি নজর পড়েছে ইটভাটা ও ভূমি ব্যবসায়ীদের। জমি অধিগ্রহন করে সরকারী-বেসরকারী স্থাপনা গড়ে তুলেছে কৃষি জমির উপরেই। বাদ যায়নি খাল-বিল, পুকুর বা নদী-নালাও। মাটি ভরাট হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বহু আগেই। সেখানে শোভা পাচ্ছে বড় বড় অট্টালিকা,পাকা-আধাপাকা বিল্ডিং, দোকানপাট ও নানা রকমারী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। এভাবে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে কৃষি জমি চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে।
তিন ফসলি আবাদি কৃষি জমিতে দেদারছে গড়ে তোলা হচ্ছে ইটভাটা। জেলার ৭টি উপজেলায় গড়ে ওঠা ইটভাটার সিংহভাগেরই লাইসেন্স নেই। ধাপে ধাপে টাকা খরচ করে অবৈধ ইটভাটাগুলো চলছে। লোকালয়ের আশপাশেও রয়েছে অসংখ্য ইটভাটা। প্রভাবশালী মালিকেরা এসব ইটভাটার আশপাশের জমি ক্রয় করে কোথাও জমির উপরিভাগ টপ সয়েল্ট মাটি কিনে নেয়ার চুক্তিতে মাটি উত্তোলন করছে ইট প্রস্তুতের কাজে ব্যবহারে। টপ সয়েল্ট বিক্রি হওয়ায় কমে যাচ্ছে মাটির উর্বরতা। ইটভাটার কারণে সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে বাতাস। ইটভাটার ধোঁয়ার কারণে গাছ, গাছের ফলমূল ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। মানুষ সর্দি-কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। ভাটায় ইট পোড়ানো কয়লা থেকে মারাত্মক ক্ষতিকর কার্বন-মনোক্সাইড নির্গত হয়। এতে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। আবার ইটভাটায় কয়লা ব্যবহার বাধ্যতামূলক থাকলেও বেশি লাভের আশায় কয়লার পরিবর্তে অবৈধভাবে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। নিধন করা হচ্ছে গাছপালা প্রকৃতি।
এদিকে কৃষি জমি গিলে খাওয়ার মিশনে ভূমি খেকোদের নানা নামে রিয়েল এস্টেট প্রকল্পগুলো প্লট আকারে জমি বিক্রি করছে কৃষি জমিতে মাটি ভরাট করে।
জামালপুর শহরের শেখের ভিটা এলাকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিনের সাথে কথা হয়। আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে বলেন, ‘দো’চোখের সামনে যা দেখছেন তা ছিল দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ। ফাঁকে ফাঁকে ছিল তাও আবার হাতে গুনা গুটা গুটা দশেক গাড়িয়াল বাড়ি, দু-একটি গৃহস্থ বাড়ি ছিল। শেখের ভিটা গ্রামের বাসিন্দাদের প্রধান পেশা ছিল গরুগাড়ি চালনা। গাড়িয়াল পাড়া নামেই অতীতে এ গ্রামটি চিনতো। আগ্রাসী জমি ব্যবসায় বদলে গেছে শেখের ভিটা গ্রামের দৃশ্যপট। সড়কের দু’পাশে বেশ কটি বেসরকারী ক্লিনিক থেকে শুরু করে নানা প্রকার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান দেখে মনে হয় বানিজ্যিক এলাকা। ভিতরে তিন ফসলি আবাদি জমির উপর অট্টালিকায় গড়ে উঠা আবাসিক এলাকা। এই এলাকায় মানুষ বাড়লেও স্থানীয় লোকের দেখা মেলা ভার। এক সময়ের কৃষি প্রধান শেখের ভিটা এলাকায় কমেছে কৃষি আবাদ। কৃষি জমি অকৃষি খাতে ব্যবহার হওয়ায় কৃষি জমি সংকুচিত হয়ে আসছে।’
নতুন বাইপাস সড়ক ও মেডিকেল কলেজ হওয়ায় শেখের ভিটার মতো চন্দ্রা,মনিরাজপুর,পলাশগড়,যোগীর ঘোপা,ছোটগড়,বামুনপাড়া ও রামনগর এলাকায় জমির মুল্য হঠাৎ করে আকাশচুম্বি হওয়ার কৃষি জমি কেনা বেচার হিড়িক পড়ে গেছে।
এদিকে অধিক মুনাফা হাতিয়ে নিতে কৃষি ক্ষেতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জমি ব্যবসায়ীদের একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। কৃষি জমি কিনে মাটি ভরাট করে বিভিন্ন রিয়েল এস্টেট কোম্পানীর সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে প্লট আকারে জমি বিক্রি করে ক্রয়কৃত জমির মূল্যের চেয়ে তিনগুন টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই আবাসন ব্যবসায় বিনিয়োগ করে কালো টাকা সাদাও করছেন অসৎ পথে উপার্জন করা টাকাওয়ালারা।
কৃষি জমি, বিল, ডোবানালার জমির কদর রাতারাতি বেড়ে গেছে। হুমড়ি খেয়ে পড়ছে জমি ব্যবসায়ী ও ভূমি দস্যুরা। উচ্চ মূল্যের লোভের ফাঁদে ফেলে ফসলি জমি ভরাট করে প্লট আকার বিক্রি করছে। সেই সাথে ভরাট করছে খাল-বিল আর ডোবা-নালা। অনেকের জমি বেদখলও হয়ে যাচ্ছে। যেখানে সেখানে সুঁই হয়ে ঢুকে ফাল হেয় বের হচ্ছে চক্রটি। প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতেও সাহস পায়না জমির প্রকৃত মালিকরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী বেশ কজন জমির মালিক জানান, আমাদের আবাদি জমি বিক্রি করার জন্য নানা ভাবে চাপ প্রয়োগ করে আসছিল। ফসলি জমি বিক্রি করবেন না বলার পরও ভূমিদস্যুরা গায়ের জোরে মাটি ভরাট অব্যাহত রাখতে বিভিন্ন এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের এনে পাহারায় বসিয়েছেন। ফলে গত কয়েক মৌসুমে এই জমিগুলোতে কোনো ধরনের চাষাবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না।
আইনকে না মেনে ফসলি জমি ভরাট হলেও সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তর এসবের বিরুদ্ধে আইনি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। উল্টো প্রতিবাদ করা জমির মালিকরা মিথ্যা মামলার শিকার ও অব্যাহত হুমকিতে দিনযাপন করছেন বলে অভিযোগ জানান তারা।
কৃষি বিজ্ঞানী ও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, কৃষিজমি সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে কৃষিজমি সুরক্ষা করতে হবে এবং কোনোভাবেই তার ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। কৃষিজমি নষ্ট করে আবাসন, শিল্প-কারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোনো অকৃষি স্থাপনা নির্মাণের উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অনুর্বর, অকৃষি জমিতে আবাসন, বাড়িঘর, শিল্প-কারখানা স্থাপনের কথা বলা হয়। যেকোনো শিল্প-কারখানা, সরকারি-বেসরকারি অফিস ভবন, বাসস্থান এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূমির ঊর্ধ্বমুখী ব্যবহারকে গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য থাকবে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা। কৃষিজমি যে কেউ ক্রয়-বিক্রয় করতে পারলেও তা আবশ্যিকভাবে শুধু কৃষিকাজেই ব্যবহার করতে হবে। একাধিক ফসলি জমি সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো অবস্থাতেই অধিগ্রহণ করা যাবে না। তবে আবাসিক উদ্দেশ্যে কৃষি জমি ক্রয় ও ব্যবহার সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১ শতাংশ চাষাবাদযোগ্য জমি হারিয়ে যাচ্ছে। কৃষিজমি কমে যাওয়ার জন্য অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যত্রতত্র শিল্পায়ন ও আবাসন গড়ে ওঠাকে দায়ী করা হচ্ছে।
দিন দিন কমছে কৃষি জমি। । খাদ্যে উদ্বৃত্ত জামালপুরে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখতে 'কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার' আইনের যথাযথ প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
শওকত জামান, সাংবাদিক, জামালপুর