ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১০ মিনিট আগে
শিরোনাম

দেশে দেশে ইফতারের বৈচিত্র্য

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২২, ১৯:১১  
আপডেট :
 ০৬ এপ্রিল ২০২২, ১৯:১৪

দেশে দেশে ইফতারের বৈচিত্র্য

মাহে রমজান ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। মুসলিম উম্মাহ সিয়াম-সাধনায় মাসটি অতিবাহিত করছে। তবে সারাদিন রোজা শেষে অন্যতম আনন্দ নিয়ে আসে ইফতার। বাংলাদেশে বাহারি নাম আর লোভনীয় স্বাদে রয়েছে নানা ধরনের ইফতারি। বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ নানা স্বাদের খাবার দিয়ে ইফতার করেন। কোথাও কোথাও একই দেশে অঞ্চলভেদে ইফতারসামগ্রীতে পার্থক্য দেখা যায়। বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা কী ধরনের খাবার দিয়ে ইফতার করে থাকেন। এসব নিয়েই এবারের আয়োজন।

ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার পূর্বে খেয়ে রোজা রাখাকে সাহরি আর সূর্যাস্তের পর খেয়ে রোজা ভাঙাকে ইফতার বলা হয়। নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কয়েকটি ভেজা খেজুর, তা না থাকলে শুকনো খুরমা/খেজুর, আর পানি দিয়ে ইফতার করতেন। একবার তিনি সফরে থাকা অবস্থায় ছাতু ও পানি মিশিয়ে ইফতার করেছিলেন। সাহরির ক্ষেত্রেও প্রাধান্য দিতেন খেজুরকে। তাই রমজান মাসে খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করাকে বলা হয় সুন্নত। বলা হয়ে থাকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইফতার করতেন আজওয়া খেজুর দিয়ে। বিভিন্ন দেশের মানুষ নানাভাবে নানা ধরনের খাদ্য সামগ্রী দিয়ে সম্পন্ন করেন ইফতার। কোথাও কোথাও একই দেশে অঞ্চলভেদে ইফতার সামগ্রীতেও পার্থক্য দেখা যায়। তবে সাধারণভাবে সব দেশের ইফতারে ফল, জুস, খেজুর, পানি, দুধ বেশ প্রচলিত। এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয় স্থানীয় কোনো কোনো আইটেম।

সৌদি আরব

নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দেশ। আর এখানে অন্যরকমভাবে ইফতার আয়োজন করা হবে এটাই তো স্বাভাবিক। সৌদি আরবের মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইফতারের আয়োজন হয়ে থাকে। এই ইফতার করতে প্রতিদিন লাখো মানুষ জড়ো হয়। মিলেমিশে ইফতার করার ফলে সৌহার্দ্যও বাড়ে। ইফতারিতে থাকে খেজুর, বিভিন্ন ধরনের ফল, জুস, তামিজ (এক ধরনের রুটি), বোরাক (মাংসের পিঠা), মানডি (মুরগি ও ভাত দিয়ে তৈরি এক ধরনের খাবার) অথবা ভেড়া/মুরগির মাংস দিয়ে তৈরি খাবসা। এছাড়া কোনাফা, ত্রোম্বা, বাছবুচান্ডর নামক নানা রকম হালুয়া। ঘরে-বাইরে বড় এক পেটের ওপর পলিথিন বিছিয়ে খাবার রেখে সবাই মিলে ইফতার করা দেশটির সংস্কৃতির অংশ। এছাড়া প্রচুর ইফতারির প্যাকেট রাস্তাঘাটে ফ্রি দেওয়া হয়। ইফতারের সময় বন্ধ রাখা হয় দোকানপাট।

ইন্দোনেশিয়া

এখানে ইফতারকে বলা হয় বুকা। অর্থ শুরু করা। এই দেশের ইফতার অপূর্ণ থেকে যায় কোলাক নামে এক ধরনের মিষ্টি খাবার ছাড়া। এই কোলাক তৈরির বিশেষ উপকরণ হচ্ছে নারকেলের দুধ ও চিনি। ইন্দোনেশিয়ানরা সাধারণত তেল ও মসলা জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলেন ইফতারে।

তবে একেবারেই যে কোনো ভাজাপোড়া থাকে না তা কিন্তু নয়। তাদের ইফতার আইটেমে সাধারণত থাকে ফল এবং ফলের রস, বিভিন্ন ধরনের ফ্রুট ককটেল, ডাবের পানি ইত্যাদি। একটু ভারী খাবারের মধ্যে থাকে কিস্যাক (সিদ্ধ চাল দিয়ে তৈরি খাবার), সোতো পাং কং (সামুদ্রিক মাছ দিয়ে তৈরি খাবার), পাকাথ (সবজি বিশেষ) ইত্যাদি। ইন্দোনেশিয়ায় বেদুক বাজানোর মাধ্যমে ইফতারের সময় নিশ্চিত করার রেওয়াজ রয়েছে। বেদুক অনেকটা আমাদের দেশের সাইরেনের মতো।

ইরাক

মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকে এখন আর আগের মতো জৌলুশ নেই। আগের মতো জৌলুশ না থাকলেও আপন ঐতিহ্যে রোজাকে স্বাগত জানান তারা। দেশটির ইফতারেও থাকে নানা বৈচিত্র্য। দেশটিতে গরু, মহিষ বা ছাগলের দুধে রোজা ভাঙেন বেশিরভাগ মানুষ। খেজুরের সঙ্গে পান করেন বিশেষ ধরনের শরবত। তাছাড়া মিষ্টি, কাবাব, মুরগির মাংসের নাওয়াশিফ, খেজুর-বাদাম-নারকেল-চিনি-জাফরান মেশানো বিস্কুট ক্লেইচা খুবই জনপ্রিয় তাদের কাছে। থাকে টক দই দিয়ে দিয়ে তৈরি করা বিশেষ এক ধরনের শরবত। মিষ্টান্ন হিসেবে থাকে মাহালাবি। যাকে বলা যায় বিশেষ ধরনের দুধের তৈরি পুডিং। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী তারা ইফতার করে থাকে। ইরাকিরা একসঙ্গে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ইফতার আদান প্রদান করতে বেশি পছন্দ করেন। অনেক সময় তাদের দেখা যায় বাড়ির খোলা আঙিনা বা ছাদে ইফতার করতে।

দুবাই

খেজুর ও দুধ এই দুটি আইটেম ইফতারের ক্ষেত্রে খুবই জনপ্রিয় দুবাইয়ে। তারা বেশ ভারী ইফতার করতে পছন্দ করেন। রোজা ভাঙার পর খেয়ে থাকেন হারিরা নামক ভেড়ার মাংস ও মসুর ডাল দিয়ে তৈরি করা বিশেষ এক ধরনের স্যুপ। এছাড়া আছে মালফুফ। এটি তৈরি করা হয় মাংস, ভেজিটেবল রোলের সাহায্যে। ভেড়ার মাংস দিয়ে তৈরি ‘ওউজি’। রয়েছে আরেকটি জনপ্রিয় খাদ্য নাম কউশা মাহসি। এটি মাছের তৈরি একটি খাবার। এছাড়া মিষ্টান্ন হিসেবে থাকে চিজ দিয়ে তৈরি পেস্ট্রি যার নাম ‘কুনাফেহ’। তাদের এই আয়োজনকে সম্মিলিতভাবে ‘মেজে’ বলা হয়। তবে এলাকাভেদে এদের খাবারের বৈচিত্র্য ও ভিন্নতাও দেখা দেয়।

পাকিস্তান

পাকিস্তানে বেশ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে পবিত্র রমজান পালন করা হয়। তাদের ইফতারেও থাকে হরেক রকম আয়োজন। ইফতারে যে আইটেম অবশ্যই থাকবে সেটা হলো রুটি ও মাংস। এটা তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার। তাছাড়া আরও যা যা থাকে সেগুলো হলো ফল, ফলের সালাদ, ফালুদা, জুস, বিভিন্ন ধরনের শরবত, রোল, টিক্কা, তান্দুরি কাটলেট, ঘিলাফি কাবাব, নুডলস কাবাব, সফিয়ানি বিরিয়ানি ইত্যাদি।

ভারত

বিশাল এক দেশ ভারত। মুসলিম প্রধান দেশ না হলেও এই দেশে অনেক মুসলিমের বসবাস। সাধারণত এই দেশের লোকজন তাদের মুঘল আমলের ঐতিহ্যবাহী খাবার দিয়ে ইফতার করতে পছন্দ করেন। তাছাড়া এখানকার একেক রাজ্যে ইফতারির রয়েছে নিজস্ব স্বকীয়তা। যেমন হায়দ্রাবাদের লোকজন খেতে পছন্দ করেন হালিম। তামিলনাড়ু ও কেরালায় ইফতার হয় ননবো কাঞ্জি নামক এক ধরনের খাবার দিয়ে। কলকাতায় আবার দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের কাবাবের চল। তাই তাদের ইফতারে খেজুর ও বিভিন্ন ধরনের ফলের পাশাপাশি দেখা যায় চিকেন শর্মা, বটি কাবাব, কাটলেটসহ ইত্যাদি মুখরোচক খাবার।

মিসর

দেশটিতে রোজা শুরু হয় বেশ ধুমধাম করেই। দুপুরের পরই অলিগলিতে বসে ইফতারির পসরা। সাধারণত পানি ও খেজুর দিয়ে রোজা ভাঙেন মিসরীয়রা। তবে প্রধান ইফতার আইটেমে থাকে আটা, মধু, কিশমিশ, বাদাম ছড়ানো কেকজাতীয় কোনাফা ও কাতায়েফ। তাছাড়া খেজুর, খুবানি কালোজাম মেশানো ফলের ককটেল খুশাফ, মলোকিয়াও খুবই জনপ্রিয় দেশটিতে। এক বিশেষ ধরনের পানীয়ও তৈরি করেন মিসরীয়রা, যার নাম কামার আল দিনান্দ আরাসি। শুকনা আখরোট সারা দিন পানিতে ভিজিয়ে রেখে পানীয়টি তৈরি করা হয়। রমজানে তাদের আরেকটি বিশেষত্ব হলো চাঁদ আকৃতির এক ধরনের রুটি তৈরি করা, যার নাম খাবোস রমজান। মিসরীয়দের রেওয়াজ হলো স্বজন ও বন্ধুদের বাসায় ইফতার করার। তবে ক্যাফে বা রেস্তোরাঁতে ইফতার করতে পছন্দ করেন অনেকে। দেশটির বিভিন্ন হোটেলে দেখা যায় বিভিন্ন খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেছেন অনেকে।

মালয়েশিয়া

এই দেশে সাধারণত রোজা ভাঙা হয় শুকনো খাবার বা খেজুর দিয়ে। ইফতারের আইটেমে থাকে তাদের স্থানীয় একটি খাবার নাম বারবুকা পুয়াসা। এটি মূলত আখের রস ও সয়াবিনের দুধ দিয়ে তৈরি এক ধরনের মিষ্টান্ন। এ ছাড়া তাদের ইফতারে থাকে পপিয়া বানাস, নাসি আয়াম, লেমাক লাঞ্জা, আয়াম পেরিক নামে স্থানীয় অন্যান্য খাবার। তাছাড়া পুরো রমজান মাস জুড়ে বুবুর ল্যাম্বাক নামে এক বিশেষ ধরনের খাবার স্থানীয় মসজিদ থেকে রোজাদারদের বিনামূল্যে দেওয়া হয়। নারকেলের দুধ, চাল, মাংশ, ঘি ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা হয় বিশেষ এই খাবারটি। এই খাবারটি দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়েছিল ৫০ বছরের বেশি সময় আগে কুয়ালামপুরের কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে।

তুরস্ক

ইফতারের আয়োজন থাকে বেশ জমকালো। ইফতারের লিস্টে থাকে বিখ্যাত পাইড নামক রুটি, খেজুর, জলপাই, বিভিন্ন ধরনের পনির, পাস্তিরমাহ (মসলাই গরুর মাংস), সসেজ, ফলমূল, সবজি ও মধু। খাবার টেবিলে অবশ্যই থাকবে স্যুপ। তাছাড়া রমজান মাসে তাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে বিশেষ ধরনের একটি কাবাব। যার নাম ‘রমজান কিবাবি’। এছাড়া তাদের রয়েছে নিজস্ব এক ধরনের বিশেষ মিষ্টি। যা তৈরি করা হয় আটা কাজুবাদাম, আখরোট ও মধু দিয়ে। এই মিষ্টির সাম সিলুলি। তুরস্কের অধিবাসীদের কাছে এই মিষ্টি খুবই জনপ্রিয়।

আফগানিস্তান

যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান। রমজানকে ঘিরে বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো আফগানিস্তানেও কমতি নেই আয়োজনের। খেজুরের পাশাপাশি পুঁইশাক, আলু ও অন্যান্য সবজি প্রাধান্য পায় ইফতার আইটেমে।

এছাড়া ইফতারে আরও অনেক খাবারের সঙ্গে থাকে রুটি, স্যুপ, পেঁয়াজু, গোশত তরকারি, ফ্রুট সালাদ, কাবাব, বেগুনি, ফ্রেশ ও শুকনো ফল। দেশটির রাস্তায় রাস্তায় পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা যায় অনেককে যাতে করে রোজা ভাঙতে পারেন রোজদাররা।

বাংলাদেশ জার্নাল/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত