ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৯ মিনিট আগে
শিরোনাম

জাবির তারকাগর্ভা সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ

  ফরিদুর রেজা খান, জাবি প্রতিনিধি

প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২২, ১৩:৩৪  
আপডেট :
 ০৬ আগস্ট ২০২২, ১৯:২৪

জাবির তারকাগর্ভা সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ
ছবি: প্রতিনিধি

চমৎকার ও অনন্য নির্মাণশৈলী এবং জাতীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ভূমিকার দিক থেকে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ এক মঞ্চ সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ, দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যার অবস্থান। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, জহির রায়হান মিলনায়তন ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গা থেকে কাজ করা ক্রিয়াশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ও গোষ্ঠীগুলোর প্রাণবন্ত সব আয়োজনে মাসের প্রায় প্রতিটি সপ্তাহেই উৎসবমুখর ও জনাকীর্ণ থাকে বিশ্ববিদ্যালয় জনপদের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত মুক্তমঞ্চ প্রাঙ্গণ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, সামনে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র ও ক্যাফেটেরিয়াসহ-এর আশেপাশের এলাকা।

শুধু ক্যাম্পাসবাসীই নন, ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ নিয়ে আগ্রহ আছে দেশের বৃহত্তর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, অনুশীলনকারী ও বোদ্ধাদের মাঝেও। তাদের মনোযোগের একটি বড় জায়গা জুড়ে থাকে এই মঞ্চের নিয়মিত নানান আয়োজন।

‘শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার নিউক্লিয়াস’ খ্যাত সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চের একসময়ের নিয়মিত মুখেরা দেশ ও দেশের পরিধি ছাড়িয়ে দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছেন শিল্প ও সংস্কৃতির নানা অঙ্গনে। নিজ ক্ষেত্রে প্রথিতযশা হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। হয়তো এজন্যেই এমন জনশ্রুতি, ‘জাবির সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ তারকাগর্ভা’।

যাদের উদ্দেশে ও চিন্তায় জন্ম মঞ্চের

ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, উচ্চতর শিক্ষায় নাট্যশাস্ত্র অধ্যয়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক নাট্যচর্চায় দেশের পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান জাবির নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনেই আশির দশকে নির্মিত হয় সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ। উদ্দেশ্য, তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞানের পাশাপাশি মঞ্চের পেশাগত অভিজ্ঞতার্জনে বিভাগটির শিক্ষার্থীদের একটি বড় সুযোগ করে দেয়া। অন্যদিকে, হুমায়ুন ফরীদিদের মতো সংগঠকদের হাত ধরে জাবিতে নাট্য তৎপরতা তখন তুঙ্গে। সে সময়টায় আবার একটু একটু করে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক প্রথম নাট্যদল জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য সংগঠক ও অধ্যয়নকারী-অনুশীলন কারীদের চাহিদার গুরুত্ব অনুধাবন করে স্বতন্ত্র একটি মঞ্চ স্থাপনে প্রস্তাবনা নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক এগোতে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বিখ্যাত নাট্যকার ও নাট্য-গবেষক নাট্যাচার্য অধ্যাপক ড. সেলিম আল দীনের তৎপরতায় মুক্তমঞ্চ নির্মাণের প্রাথমিক প্রক্রিয়া দ্রুত এগোয়। চিত্রশিল্পী মোস্তফা মনোয়ার, নির্মাতা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু এবং জাবির ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে নিয়ে বসে সেলিম আল দীন ঠিক করেন, নতুন এই মুক্তমঞ্চটি প্রাচীন গ্রিক এরিনার ওপেন এয়ার স্টেজের (মুক্তমঞ্চ) আদলে নির্মাণ করা হবে।

সুদৃশ্য এই মঞ্চটির নকশা করেছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও স্থপতি আলমগীর কবির। জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক, বিশিষ্ট নাট্যকার কায়জার আহমেদের নির্দেশনায় ‘শকুন্তলা’ মঞ্চায়নের মাধ্যমে ১৯৮১ সালের এক ভোরে অভিষেক হয় নবনির্মিত মুক্তমঞ্চের।

শুরুতে কোনো নামকরণ করা না হলেও পরবর্তীতে মঞ্চটির স্বপ্নদ্রষ্টা প্রয়াত সেলিম আল দীনের স্মৃতিরক্ষায় তার নামে মঞ্চটির নামকরণ করা হয়।

মেধাবী নির্মাণশৈলীতে অনন্য

প্রাচীন গ্রিসের নাট্যজনেরা অসমতল উপত্যকা কেটে ঢালু জায়গায় বানাতেন মঞ্চ, সমতল থেকে উঁচুতে পাহাড় কেটে দর্শকসারি। নাটক মঞ্চায়িত হতো ভোরে। দর্শকসারি পেরিয়ে নিচের দিকে ক্রমশ ঢালু হয়ে আসা সমতলে বানানো পূর্বমুখী খোলা সেসব মঞ্চে উদীয়মান সূর্যের আলো ঠিকরে পড়তো অভিনেতাদের মুখে। দর্শকসারির সব প্রান্তে শব্দের পৌঁছার বিষয়টি নিশ্চিত করে নকশা পরিকল্পনা করা হতো এসব মঞ্চের। কৃত্রিমভাবে শব্দ বা আলোক ব্যবস্থাপনা সে সময় চিন্তারও বাইরে ছিলো।

মঞ্চটি নির্মাণে গ্রিসের সাথে উঁচু-নিচু মৃত্তিকার জাহাঙ্গীরনগরের সাদৃশ্য ও সামঞ্জস্যতার করেছেন মুক্তমঞ্চটির পরিকল্পনাকারী ও নির্মাতারা। উল্লেখ্য, গ্রিক এরিনার ওপেন এয়ার স্টেজের (মুক্তমঞ্চ) আদলে ভারতীয় উপমহাদেশে এ ধরণের মঞ্চ নির্মাণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রথম। চারদিক খোলা ও সমতল থেকে নিচু জায়গায় নির্মিত হয়েছে সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ। লাল সিরামিক ইটে বাঁধানো দৃষ্টিনন্দন এই মঞ্চের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, বিকল্প কোনো কৃত্রিম শব্দ ও আলোক ব্যবস্থাপনা ছাড়াই দর্শকসারির প্রতিটি প্রান্ত থেকে মঞ্চের উপস্থাপনা স্পষ্ট দেখা ও শোনা যায়। মূলত নাট্য উপস্থাপনার জন্য নির্মিত হলেও এই মঞ্চে রয়েছে সব আঙ্গিকের উপস্থাপনার সুব্যবস্থা, বিশেষ প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে মঞ্চের কাঠামোতে আনা যায় পরিবর্তনও।

মঞ্চের বিপরীতে ক্রমশ আকাশের দিকে উঠে যাওয়া ১৪টি সারিতে একসাথে পনেরোশ’র কাছাকাছি দর্শক অনায়াসে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারেন। চারদিক খোলা মঞ্চে বাতাসের সুষ্ঠু প্রবাহ নিশ্চিত হওয়ায় বর্ষা ব্যতীত যে কোনো ঋতুতে আয়োজকরা দর্শকদের একটি ক্লান্তি বিহীন ও আনন্দময় আয়োজন উপভোগের সুযোগ করে দিতে পারেন।

অভিষেকের দিনের মুখ যারা, স্মৃতি থেকে

কায়জার আহমেদের নির্দেশনায় ‘শকুন্তলা’ মঞ্চায়নের মাধ্যমে অভিষেক ঘটে সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চের। অভিষেকের দিনের এই নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ফৌজিয়া ইয়াসমিন শিবলী (নাম ভূমিকায়), শহীদুজ্জামান সেলিম, ফারুক আহমেদ, শুভাশীষ ভৌমিক, আইয়ুব খান, আখতার আহমেদ রাশা, আমিরুল এহসান, হারুন উর রশীদ, ইন্দুপ্রভা ও ইয়াসমিন হক বিদ্যুৎ প্রমুখ।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রথিতযশা নাট্যকর্মী ও টিভি অভিনেতা শুভাশীষ ভৌমিক বাংলাদেশ জার্নালকে বলছিলেন, ‘আজ আমার বয়স ৬২, আর আজ থেকে ৪২ বছর আগে সেদিন আমার বয়স ছিলো কুড়ি। সেদিনের কথা মনে হলে আজও শরীরে উত্তেজনা কাজ করে, মনে হয় জেনো সেই ভোরটায় ফিরে গেছি।’ কয়েকদিন আগেই ঢাকা থিয়েটারের শকুন্তলার মঞ্চায়ন দেখে এসে মনে হয়েছিলো আর যাই করি বা না করতে পারি আমাদের উপস্থাপনা তাদের কাছাকাছি নিয়ে যেতেই হবে, বলছিলেন শুভাশীষ ভৌমিক।

বিখ্যাত নাট্যাভিনেতা ফারুক আহমেদ বলেন, ‘চাঁদে মানুষ যেভাবে প্রথম পা রাখে, ঠিক একইভাবে ঐ মঞ্চ থেকেই অভিনেতা হিসেবে আমার অভিষেক ঘটে। নাটকের প্রথম সংলাপই ছিলো আমার। ঘোষণার মাধ্যমে নাটক শুরু হওয়ার পর মঞ্চে এসে আমি সেদিন আমার অভিনয়জীবনের প্রথম সংলাপ দেই।’

অভিষেকের দিনে মঞ্চে জনসমাগম ছিলো নাটকে অভিনয় করা ব্যক্তিদেরও ধারণার বাইরে। শুভাশীষ ভৌমিক বলছিলেন, ‘আলো ফুটে সকাল হওয়ার আগেই কানায় কানায় দর্শকপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো মুক্তমঞ্চ। সব হল থেকে দলে দলে বের হয়ে আমাদের বন্ধুরা, অনুজ ও অগ্রজরা মুক্তমঞ্চে এসে ঢুকছিলেন। রাত পেরিয়ে ভোর হওয়ার সে সময়টার সবাই যখন ঘুমে, তখন মানুষের পদচারণায় গমগম করছিলো মুক্তমঞ্চ।’ ফারুক আহমেদ জানান, তালগাছের পাতায় মঞ্চসজ্জা করা হয়েছিলো সেদিন। মঞ্চসজ্জার কাজ করেছিলেন অভিনেতা আফজাল হোসেন। নাটকের কলাকুশলীদের রূপসজ্জা করেছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) নিবন্ধিত রুপসজ্জাকার মোয়াজ্জেম হোসেন। মুক্তমঞ্চ অভিষেকের এই আয়োজন দেখতে সেদিন ভোরে ঢাকা থেকে জাহাঙ্গীরনগর এসেছিলেন অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ঢাকা থিয়েটারের নাট্যকর্মীরা।

‘ভালো কাজের আলো কমবেশি ছড়াবেই’

তারকাদের আঁতুড়ঘর খ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ। পেশাদার পরিধিতে নিয়মিত অনুশীলনের সুযোগ করে দিয়ে এই মঞ্চ জন্ম দিয়েছে অনেক প্রতিভাবান খ্যাতিমান শিল্পীর। দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও এই মঞ্চের অবদান ও গুরুত্ব কম নয়। অভিনেতা ফারুক আহমেদের ভাষায়, ‘সময় নিক, কিন্তু ভালো কাজের আলো কমবেশি ছড়াবেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও তার মুক্তমঞ্চের আলোও আজ ছড়িয়ে গেছে দেশ ও আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনে।’

শহীদুজ্জামান সেলিম, ফারুক আহমেদ বা শুভাশীষ ভৌমিকরাই শুধু নন, এই সময়ের সুমাইয়া শিমু, জাকিয়া বারী মম, মিম মানতাসা, আফসানা আরা বিন্দু, সজল নূর বা আসাদুজ্জামান আবীরদের মতো অভিনয়শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদেরও কোলে তুলে বড় করেছে সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ।

সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জাহাঙ্গীরনগরবাসীর এই সংযোজনের ধারা আগামীর দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে বলে প্রত্যাশা এই মঞ্চের শুরুর দিনগুলোর সংগঠকদের।

বাংলাদেশ জার্নাল/কেএ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত